সমকালের প্রতিবেদন...

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা: খুনিদের পেছনে কারা

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর প্রশ্ন উঠেছে- খুনিদের পেছনে কারা? কাদের ইন্ধনে প্রত্যাবাসনের পক্ষে জোরালো ভূমিকায় থাকা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হলো- সে প্রশ্ন ভাবাচ্ছে বাংলাদেশকে। বাইরের কোনো দেশ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে- এমন কথাও উঠেছে এর মধ্যে। শুরু থেকে যে তিনটি কারণ সামনে রেখে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করেছেন, তার মধ্যে বাইরের কোনো গ্রুপের ইন্ধনের বিষয়টিই প্রধান বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

তবে নিহত মুহিবুল্লাহর ভাগ্নে রশিদ উল্লাহ দাবি করেছেন, তার মামাকে হত্যার আগের দিন একটি গ্রুপ আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছিল। প্রকৃত হত্যাকারীদের তথ্য ক্যাম্পের মানুষের কাছেই পাওয়া যাবে বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে হত্যার পাঁচ দিন পার হলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল এমন কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে সন্দেহভাজন পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের ধারণা, খুনিরা ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকতে পারে।

সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার ধারণা, মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িতরা সুকৌশলে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। কখন কোথায় কীভাবে হামলা করলে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা যাবে- এটা তারা ভালোমতো জানত। তাই ঘটনার পর কোনো খুনি তাৎক্ষণিক ধরা পড়েনি। পাশাপাশি ক্যাম্পের নিরাপত্তা যে সময় কিছুটা ঢিলেঢালা থাকে, সেই সময়কেই বেছে নেওয়া হয়।

সোমবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার প্রধান সড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামের সংগঠনের কার্যালয়ের পাশে একটি ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনে নিরাপত্তা দিচ্ছিল এক দল এপিবিএন সদস্য। ঘরের ভেতরে ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর স্ত্রী, সন্তান ও তার স্বজনরা।

মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ বললেন, ‘আমরা খুব বেশি ভালো নেই। কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কিন্তু একটি কথা পরিস্কার বলতে চাই- আমরা এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিদের শক্ত শাস্তি চাই।’

মুহিবুল্লাহর ভাগ্নে রশিদ উল্লাহ বললেন, ‘এসব লিখে কী হবে? আমার মামাকে যারা আগে থেকে হুমকি দিয়ে আসছিল, তারাই হত্যা করেছে। ক্যাম্পের অনেকে বিষয়টি জানেন। তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত হত্যাকারীদের নাম পাওয়া যাবে। হত্যার আগের দিন একটি গ্রুপ কেন এখানে আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল- সেটিও তদন্ত করতে হবে।’

স্থানীয় কারও কারও ভাষ্য, ঘটনাস্থলে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আবদুর রহিম ওরফে রকিম, মোজাম্মেল ওরফে লাল বদিয়াসহ চারজন। এ ছাড়া সেদিন লম্বাশিয়ার মরকজের পাহাড় এলাকায় মো. সিরাজ, সৈয়দ আলম, নুর সাবা মো. রফিক, খায়রুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন গোপন আলোচনায় বসে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ঘটনার দিন লোকজনের সঙ্গে আলোচনাকালে মুহিবুল্লাহর অফিসে আমিও যোগ দিই। সেখানে রোহিঙ্গাদের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছিল। অনেককে সাহস ও সান্ত্বনা দেন মুহিবুল্লাহ। আলোচনা শুরুর তিন-চার মিনিট পরই মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ৭-৮ জন অস্ত্রধারী অফিসে প্রবেশ করে। তারা জানতে চায়- কেন ব্লকে ব্লকে টিম তৈরি করা হচ্ছে? মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে উদ্বুদ্ধ করতে ওই টিম তৈরি করা হয়- এটা বলামাত্রই মুহিবুল্লাহকে গুলি করা হয়। সন্ত্রাসীদের পরনে ছিল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও হাফ গেঞ্জি।

মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন সমকালকে বলেন, প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে মুহিবুল্লাহ হত্যার শিকার হন- বিষয়টি এভাবে চিত্রায়িত করা পুরোপুরি ঠিক হবে না। ঘটনার পরপরই মুহিবুল্লাহর ভাই যে কথাগুলো বলেছেন তা আমলে নিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করতে হবে। আবার মুহিবুল্লাহ অনেক দিন ধরেই তাকে ভয় দেখানোর কথা বলে আসছিলেন। কারা তাকে হুমকি ও ভয় দেখাত, এসব তদন্তের আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ তাদের সম্মান, অধিকার নিয়ে নিজ মাটিতে ফেরত যেতে চায়। মুহিবুল্লাহ তাদের এ স্বপ্ন দেখিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের মুক্তির দূত হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয়, তার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।

১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাইমুল হক সমকালকে বলেন, মুহিবুল্লাহর খুনিদের গ্রেপ্তার করার বিষয়কে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে খুনিরা পালিয়ে গেছে- এটা মনে করি না। অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা বেআইনি কাজে জড়িত এমন বেশ কিছু গ্রুপের তালিকা তারা তৈরি করেছেন। কে কী ধরনের অপরাধে জড়িত তা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া যারা নিয়মিত গোপনে ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত করছে, তাদের ওপরেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপরাধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যাম্প থেকে নিয়মিত তথ্য পাচার হচ্ছে। মিয়ানমারের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা তথ্য পাচার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও মিয়ানমারে কাজ করে।

কক্সবাজারে দায়িত্ব পালন করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, অতীতে দেখা গেছে, ক্যাম্পে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার পর অপরাধীরা দ্রুত পালিয়ে পাহাড়ে বা দেশের বাইরে চলে গেছে। মুহিবুল্লাহর হত্যার ঘটনায় জড়িতদের ক্ষেত্রেও এমন একটি আশঙ্কা তাদের রয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩২ জন বড় ইয়াবা গডফাদারের তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডীতে আটক ১৪ লাখ ইয়াবা চালানের সঙ্গে রোহিঙ্গা গডফাদাররা জড়িত। পুলিশের অভিযানের মুখে তাদের অনেকে এখন মিয়ানমারে পালিয়ে গেছে। মিয়ানমারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের প্রশ্রয় দেয় বলে তথ্য রয়েছে।

এসপি বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত অভিযান চলছে।

/সমকাল

আরও খবর