আদালতে বোমা হামলা: কক্সবাজারের জাবেদের মৃত্যুদন্ড থেকে যাবজ্জীবন!

কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক •

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র জাবেদ ইকবাল। ২০০৫ সালে বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

তিনি হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে অনুতপ্ত ও একটি ভ্রান্ত ধারণার অনুসারি ছিলেন বলে জানান। এখন জাবেদ ইকবাল বুঝতে পেরেছেন, তিনি ভুল করেছেন, এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান। মামলার শুরু থেকে শেষপর্যন্ত আদালতে হাজির ছিলেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতকে সহযোগিতা ও সবকিছু বিবেচনায় ১৬ বছর আগে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আত্মঘাতী ওই বোমা হামলার ঘটনায় জেএমবির নেতা জাবেদ ইকবালকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

রোববার (৩ অক্টোবর) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুল হালিম এ রায় ঘোষণা করেন। জঙ্গি জাবেদ ইকবাল কক্সবাজার জেলার সদর থানার খুরুশকুল এলাকার মাওলানা আবদুল আউয়াল সিকদারের ছেলে।

জাবেদ ইকবাল ও বোমা মিজানের জন্য রাষ্ট্রের নিয়োজিত আইনজীবী মো. ইউনুস বলেন, জঙ্গি জাবেদ ইকবালকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বিষয়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, জাবেদ ইকবাল কোর্টের মধ্যে অনুতপ্ত হয়ে স্বীকার করেছেন। এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত ও একটি ভ্রান্ত ধারণার অনুসারি ছিলেন। এখন জাবেদ ইকবাল ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি ভুল করেছেন, এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান। তার বয়স অল্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদালতে হাজির ছিলেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতকে সহযোগিতা করেছেন। সবকিছু বিবেচনায় আদালত মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

চট্টগ্রাম সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনোরঞ্জন দাশ বলেন, সারাদেশে আদালতে হামলার উদ্দেশ্য বিষয়ে নীলনকশার পরিকল্পণকারী, সহয়তাকারী ও প্ররোচনাকারী ছিলেন জেএমবির সদস্য জাবেদ ইকবাল।

আসলে এই নীলনকশা ও পরিকল্পণা করা হয়েছিল বিচার অঙ্গনে যারা বিচার করেন, বিচারকদের হত্যা এবং বিচারকদের যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করে তাদের হত্যা করা। এটা ছিল অনেক দিনের পরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা অনুসারে জাবেদ ইকবাল নিজে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ও বোমা সংগ্রহ করেছেন। তার কাছ থেকে বোমা ও বহু জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিচারকদের হত্যা ও আইন প্রয়োগকারী বিচারকাজে সহায়তাকারীদের হত্যা করা।
দুর্ভাগ্যবশত জজশিপ ক্যান্টিনের সামনে প্রথম বোমাটি বিস্ফোরণ হওয়ায় পুলিশ সদস্য রাজিব বড়ুয়া ও পথচারী নিহত হয়েছেন। ১৪ জন ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের অঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

আদালতে জাবেদ ইকবাল দোষ স্বীকার করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মনোরঞ্জন দাশ বলেন, জাবেদ ইকবাল আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করেনি, কিন্তু অন্য মামলায় জাবেদ ইকবালের দোষ স্বীকার রয়েছে। এ মামলাসহ আরও ১০টি মামলা রয়েছে। সেই মামলাগুলোতে জাবেদ ইকবালের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আছে।
আদালতে কয়জন বোমা মেরেছিল এমন প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী বলেন, আদালতে একজন বোমা মেরেছিল। জাবেদ ইকবালকে আদালতে ৭ জন সাক্ষী পরিচয় শনাক্ত করেছে। তার কাছ থেকে বোমা এবং বোমার বারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। টুপি ব্যবসায়ী সাক্ষী দিয়ে গেছে যে সবকিছু আদালতে বিবেচনা করেছে।

জাবেদ ইকবাল কোন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন বিষয়ের ছাত্র নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। সম্ভবত আররি বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
জাবেদ ইকবাল ও বোমা মিজানের জন্য রাষ্ট্রের নিয়োজিত আইনজীবী মো. ইউনুস বাংলানিউজকে বলেন, রায়ের প্রতি আমরা সন্তুষ্ট নই। ঘটনার সঙ্গে জাবেদ ইকবাল জড়িত থাকার কোনো ধরনের প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব। চাঞ্চল্যকর মামলা, ঘটনার সঙ্গে অনেকে জড়িত। শুধু অভিযোগপত্রে ৫ জনের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদের দিয়ে এই ঘটনা হয়নি। এটার অন্তরালে আরও অনেক লোক ছিল। পাচঁজনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। জাবেদ ইকবাল ও বোমা মিজানকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। এদের মূল আসামি হিসেবে ধরা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল হাসান বলেন, জাবেদ ইকবালের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু জাবেদ ইকবাল আদালতকে সাপোর্ট করেছে, সহযোগিতা করেছে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। পুরাটা একই সঙ্গে সামনে সামনি ছিল না, পুরাটা একটি গ্যাং, জাবেদ ইকবালের পুরোটা নলেজে ছিল, যার কারণে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

জঙ্গিদের রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের চারদিকে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে জানিয়ে এডিসি কামরুল হাসান বলেন, জাবেদ ইকবালের সঙ্গে পিতা দেখা করতে চায়, আদালতে বলেছিল জাবেদ ইকবাল। আদালত জাবেদ ইকবালকে পিতার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিতে বলেছে। রায় শেষের পরে আদালতে বাইরে পরিবারের সদস্যদের ডাকাডাকি করা হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ আসেনি।

আদালত সূত্রে জানা যায়, কোতোয়ালী থানার মামলা নং- ৩৮(১১)২০০৫। বোমা হামলার পরের বছর ২০০৬ সালের ১৮ মে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক হ্লা চিং প্রু জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ ও বোমা তৈরির কারিগর জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে অন্য একটি মামলায় বাকি তিনজন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই এবং জেএমবির সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি নামের তিন আসামির ফাঁসির আদেশ হয়।

ফলে এ মামলা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মামলাটির অভিযোগ গঠন করে। পরে মামলার বিচার চলছিল প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ২০০৮ সালে মামলাটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করা যায়নি। পরে মামলাটি প্রথম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে ফেরত যায়। পরে পুনরায় ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মামলাটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ট্রাইব্যুনালে পাঠান চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ।

২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের গঠন করা হলে চট্টগ্রামের জঙ্গিদের সব মামলা এই ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। একই বছর ৬ আগস্ট মামলাটি সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালে রিসিভ করেন। চট্টগ্রাম সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের মামলা নম্বর ৬৭/২০১৮। মামলার একমাত্র আটক আসামি জঙ্গি জাবেদ ইকবাল কারাগারে আটক আছেন। বোমা মিজানকে ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে হাজিরা দেওয়ার জন্য ময়মনসিংহের আদালতে নেওয়া হয়। পথে ত্রিশাল এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশের কাছ থেকে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় অন্য জঙ্গিরা। এর মধ্যে একজন বোমা মিজান। এরপর বোমা মিজানকে আর গ্রেফতার করা যায়নি।

২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পুলিশ চেক পোস্টের সামনে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া ও ফুটবলার শাহাবুদ্দীন। আহত হন পুলিশ কনস্টেবল আবু রায়হান, সামসুল কবির, রফিকুল ইসলাম, আবদুল মজিদসহ ১০ জন।

আরও খবর