আবদুর রহমান, বাংলা ট্রিবিউন •
১৯৯৭ সালে কক্সবাজারের টেকনাফে আসেন ভোলার নুরুল ইসলাম। কাজ শুরু করেন বন্দরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ব্যবসার কাজে যেতে হয় টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড কাস্টমস কার্যালয়ে। পরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয়। কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। একসময় নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিতে শুরু করেন।
সব ধরনের কাজ করে দেওয়ায় ক্ষমতা রাখায় ‘বন্দর ইসলাম’ নামে পরিচিতি পান। এরপর ‘বন্দর ইসলাম’ নাম বললেই কাস্টমস ও বন্দরের সব কাজ হয়ে যেতো তার। এভাবেই ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যান।
সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এ সময় তার কাছ থেকে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ জাল টাকা, তিন লাখ ৮০ হাজার মিয়ানমার মুদ্রা, চার হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা ও নগদ দুই লাখ এক হাজার ১৬০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
নুরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর র্যাব দাবি করেছিল, টেকনাফ স্থলবন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু নুরুল ইসলাম টেকনাফ কাস্টমস কার্যালয়ের নিয়োগকৃত কিংবা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী ছিলেন না বলে জানিয়েছে টেকনাফ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
তবে তার ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার কথা শুনে বিস্মিত কাস্টমস কর্মকর্তারা। তাদের প্রশ্ন, কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন নুরুল ইসলাম?
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দরের প্রধান শুল্ক কর্মকর্তা মো. আব্দুন নুর বলেন, ‘নুরুল ইসলাম নামে এখানে সরকারি কিংবা চুক্তিভিত্তিক কোনও কর্মচারী নেই এবং ছিল না। হয়তো কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালিয়ে আসছিল নুরুল ইসলাম। তার সিন্ডিকেটের বিষয়টি আমাদের নজরে আসেনি। আমার অবাক লাগছে, কীভাবে ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক মালিক হলো? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’
নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়েও কীভাবে কাস্টমসের কার্যক্রম চালাতেন নুরুল ইসলাম এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাকে দেখিনি। তবে নাম শুনেছি। তার কোনও অবৈধ ব্যবসা থাকতে পারে। তা না হলে কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন। আমরা এখানে নজরদারি বাড়াচ্ছি, যাতে কাস্টমসের নাম ব্যবহার করে আরও কেউ অপকর্মে না জড়াতে পারে।’
বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০০৩ সালে স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকে নুরুল ইসলামকে কাস্টমস কার্যালয়ে দেখেছি। বন্দরের বড় বড় ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। একসময় কাস্টমস কার্যালয়ের পাশের বাসিন্দা পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়ার আবুল আহমদ ড্রাইভারের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। পরে আবুলের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ে করেন।
এরপর শ্বশুরবাড়ির স্বজনদের নিয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর কেন্দ্রিক গড়ে তোলেন দালাল চক্র। এই চক্র মিলে সরকারের শুল্ক ফাঁকি, অনিয়ম, কাগজপত্র জালিয়াতি, পণ্য মিস ডিক্লারেশন এবং ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। কোটি টাকার মালিক বনে যান তার চক্রের লোকজনও। তার সঙ্গে জড়িত সীমান্তের প্রভাবশালীর একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। তার নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল। তবে তার অপকর্মে ‘রাজনৈতিক’ ও সরকারি কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দরের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, নুরুল ইসলাম কাস্টমস কার্যালয়ের কেউ ছিল না, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই কথা বললে হবে না। কাস্টমস কর্মকর্তাদের সামনে বসে প্রকাশ্যে সব কাজ করতো নুরুল ইসলাম। যেভাবে প্রভাব খাটাতো তাতে সবার মনে হয়েছিল বড় কর্মকর্তা। তার কথা ছাড়া অফিসের ফাইল নড়তো না। কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। টাকার ভাগ সবাই পেতো। এখন অস্বীকার করছে। তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
নুরুল ইসলামের সেন্ডিকেট সদস্যদের খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা
নুরুল ইসলাম টেকনাফ বন্দর কেন্দ্রিক দালালি সিন্ডিকেটের প্রধান। তার সিন্ডিকেটের ১৫ জন সদস্য কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পণ্য খালাস, পরিবহন সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ মালামাল খালাস করে আসছিল। সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিয়ানমার থেকে আমদানি মালামালের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রতি ঘোষণাপত্রে চার হাজার টাকা, প্রতি ট্রাকে দুই হাজার টাকা, প্রতি বিল অব এন্ট্রি থেকে ৫০০ টাকা, মালামাল লোডিংয়ে এক হাজার টাকা ঘুষ নিতো। নুরুল গ্রেফতারের পর সিন্ডিকেটের সদস্য কামরুল হাসান, রনি লিটন, নুরুল কায়েস, মুহাম্মদ ফারুক, আবু বক্কর ছিদ্দিক, এনামুল হক ও মো. মাসুম ও জব্বারসহ বাকিরা গা ঢাকা দেয়। এখন তাদের খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন।
স্থলবন্দরের ওপর নজর রাখা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেফতারের পর নুরুল ইসলামের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীসহ বেশ কিছু নাম পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের খুঁজছি আমরা। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর নুরুল টেকনাফ থেকে চলে যায়। আড়ালে বসে স্থলবন্দর ও কাস্টমসের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেছিল।’
টেকনাফ স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, নুরুল ছিলেন বন্দরের অপকর্মের মূলহোতা। তার নেতৃত্বে মিয়ানমারের আমদানি-রফতানি মালামাল থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করে আসছিল চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে মিয়ানমারে বিভিন্ন কসমেটিকস, সুপারি, স্যান্ডেল, নুডুলস ও কফিকে মিস ডিক্লারেশন দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর কোটি কোটি নিয়েছিল তারা। পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রলার-ট্রাকে অবৈধ মালামাল আনতো এবং পাচার করতো। টাকার ভাগ সবাই পেতো।
২০০৯ সাল থেকে টেকনাফে সম্পদ গড়েন নুরুল ইসলাম
টেকনাফের স্থানীয় লোকজন ও দলিল লেখকরা বলেছেন, কক্সবাজার থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত নামে-বেনামে সম্পত্তি গড়েছেন নুরুল ইসলাম। বেশির ভাগই ২০০৯-২০১৮ সালের মধ্যে করেছেন। স্ত্রী রাজিয়া ইসলামের নামে টেকনাফ পৌরসভা, লেঙ্গুরবিল ও মেরিন ড্রাইভ এলাকায় সাড়ে চার একর জমি কিনেছেন। টেকনাফ মৌজার খতিয়ান নম্বর ৪৭২০, ৫০০২ ও ৫০০৩। এসব এলাকায় একাধিক ভবন রয়েছে। তবে সম্প্রতি সেন্টমার্টিনের জমি বিক্রি করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এতদিন পর জানলাম নুরুল ইসলাম কাস্টমস কার্যালয়ের কেউ না। কিন্তু কাস্টমস কার্যালয়ে বসে নুরুল যেভাবে কাজ করতেন তাতে কারও বোঝার উপায় ছিল না। তবে তার সম্পদের কথা শুনে আমি বিস্মিত। বন্দর আর কাস্টমসের কাজ ও দায়িত্ব ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে এখানে কে কি ধরনের কাজ করছে তা জানা খুব মুশকিল। আসলে এমন অপরাধীদের ধরাও যায় না। আমরা বন্দরে নজরদারি বাড়াচ্ছি।’
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘নুরুল ইসলামকে সামনে রেখে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও দুর্নীতির মাধ্যমে একটি চক্র শত শত কোটি টাকা গায়েব করেছে। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা দরকার। পাশপাশি স্থলবন্দর থেকে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা সুবিধা নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাই।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-