মানুষের মাওতের আগে যখন মালাকুল মাওত রুহ কবজ করেন তখনো মৃত ব্যক্তি বুঝতে পায়। মৃত ব্যক্তির লাশ কবরে দাফনের পর তোমার রব কে? তোমার ধর্ম বা দিন কী? তোমার নবি বা রসুল কে? এই তিনটি প্রশ্ন এবং উত্তরের জন্য কবরের মৃত ব্যক্তিকে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ঐ সময় শুধু নাভি পর্যন্ত জ্ঞান বা চেতনাশক্তি থাকবে। নাভির নিচ থেকে বাকি অংশ প্যারালাইজডের মতো চেতনাহীন থাকবে।
নাকির এবং মুনকির ফেরেশতাদ্বয় মৃত ব্যক্তির সওয়াল এবং জবাব শেষে পুনরায় রুহ কবজ করা হবে। অতঃপর পুনরায় মৃত্যু হবে। সুরায়ে আবাসাতে মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন যে, সুম্মা আমাতাহু ফা আক্ববারাহু। অতঃপর মৃত্যু দেন এবং তাকে কবরস্থ করেন। সুম্মা ইজা শাআ আনশারাহু। অর্থাৎ, অতঃপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন, আবার পুনরুজ্জীবিত করবেন। (সুরায়ে আবাসা)।
মানুষের জীবিত আত্মা রুহ এবং দেহ মিলেই মানুষের জীবন। আর রুহ যদি আলমে আরওয়াহ-এর জগতে চলে যায়, তাহলে এই দেহটা নিষ্প্রাণ। অর্থাৎ মৃত্যু। শরীরের যে কোনো একটা অংশে আঘাত পেলে মানুষ কষ্ট পায়, যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। মানুষের শরীরের আসল অংশ হলো রুহ, সেই রুহ বের হয়ে আলমে আরওয়াহ অর্থাৎ রুহের জগতে গিয়ে যদি সিজ্জিনের আজাবে পতিত হয়, তাহলে সেই দেহ তথা জিসিমের ওপর সেই আজাবটা বর্তায়। কেননা কিয়ামতের দিবসে কবরের সেই নিষ্প্রাণ দেহকে প্রাণ দিয়ে কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
অভাবে ধৈর্য ও তাড়া থেকে মুক্তির আমল
মহান রাব্বুল আলামিন সুরায়ে মুতাফফিফিনের ১৮ এবং ১৯ আয়াতে ইরশাদ করেন যে, কখনো নয়, নিশ্চয়ই নেককার মুমিনের আমাল নামাসমূহ থাকবে ইল্লিয়িনে। আপনি কি জানেন? ইল্লিয়িন কি? (সুরায়ে মুতাফফিফিন ) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন যে ইল্লিয়িন এর অর্থ হলো জান্নাত, অর্থাৎ সপ্তম আসমানের নিচে আরশের নিচে অবস্থিত স্থানকে বলা হয় ইল্লিয়িন। নেককার মুমিনের রুহটা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ ইল্লিনে চলে যায়, (তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে বইজাবি)। আল্লামা ইবনে কাসির রহ. আরও বলেন যে, ইল্লিয়িন শব্দটি উলুউন ধাতু থেকে নির্গত অর্থাৎ উঁচু স্থান, যখন কোনো জিনিস ওপরের দিকে উঠে তখন সেটা সম্মানিত হয়ে যায় , কিমতওয়ালা হয়ে যায়।
কাল্লা ইন্না কিতাবাল আবরারি লাফি ইল্লিয়িন। ওয়ামা আদরাকা মা ইল্লিউন? কিতাবুম মারক্বুম। অর্থাৎ কখনো না। নিশ্চয়ই সেলাকদের আমল নামাসমূহ আছে ইল্লিয়িনে। আপনি কি জানেন ইল্লিয়িন কী? এটা লিপিবদ্ধ ডায়রিভুক্ত খাতা। হজরত বারা ইবনে আজিব রা. থেকে বর্ণিত যে, ইল্লিয়িনে মুমিন বান্দাদের রুহ বা আত্মা এবং আমলনামাসমূহ রাখা হয়। আল্লাহ পাক সুরায়ে আত তাতফিফের ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন যে, কাল্লা ইন্না কিতাবাল ফুজ্জারি লাফি সিজ্জিন। ওয়ামা আদরাকা মা সিজ্জিন? কিতাবুম মারক্বুম। ওয়াইলুই ইয়াওমাঈজিল লিল মুকাজ্জিবিন। কখনো না। নিশ্চয়ই পাপাচারীদের আমল নামাসমূহ সিজ্জিনে আছে। আপনি জানেন সিজ্জিন কী? এটা লিপিবদ্ধ ডায়ারি খাতা। সে দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের। সিজ্জিন শব্দের অর্থ কারাগার, বা বন্দিদশা।
হজরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত যে, সিজ্জিনে জাহান্নামি, পাপাচারীদের রুহ এবং আমল নামাসমূহ রাখা হয়। হজরত ইবনে কাসির রহ. হজরত ইবনে রজব রহ. এর অধিকসংখ্যক হাদিসে বর্ণিত করেন যে, জাহান্নামিদের জন্য সিজ্জিন বা শাস্তিখানা, বন্দিখানা হলো সাত নম্বর জমিনের নিচের স্থান। যেমন সাত আসমান এবং সাত জমিন। সাত নম্বর আসমানের ওপরের উঁচু সম্মানিত স্থান, মর্যাদা ওয়ালা জায়গা হলো নেককার মুমিনের জন্য। আর জমিনের সাত নম্বর নীচের স্থান হলো বদকার, পাপাচারী, জাহান্নামিদের স্থান আর সেই জায়গাকেই বলা হয় সিজ্জিন। সুতরাং মৃত্যুর পরপরই আলমে আরওয়াহ অর্থাৎ রুহের জগৎ এবং আলমে বারজাখ অর্থাৎ কবরের জগত একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে রুহের ওপর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। আর রুহটা হলো মানুষের দেহের মূল চালিকাশক্তি।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের যত মাধ্যম
রুহ থাকলে মানুষ বেঁচে থাকে, আর রুহ না থাকলে মানুষ মারা যায়। রুহ যদি ইল্লিয়িনে অবস্থান করে, তাহলে সেই ব্যক্তি কবরের জিন্দেগিতে আরাম তথা সুখ শান্তিতে কুশাদাহ পূর্ণ অবস্থায় থাকবে। আর রুহ যদি সিজ্জিনে চলে যায়, তাহলে সে ব্যক্তির কবরের জিন্দেগি আজাবদায়ক হয়ে উঠবে। কবরের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির রুহ খুবই অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত। রসুলে পাক সা. একদা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা কবরে আজাব হচ্ছে বুঝতে পেরে, তিনি ঐ কবরে মৃত ব্যক্তির কবরের বুক বরাবর একটা তাজা কুলগাছের ডাল ভেঙে ঐ আজাবকৃত কবরের ওপরের ঐ কুলগাছের ডালটি পুঁতে দিলেন। অতঃপর দোয়া পাঠ করলেন, আল্লাহুম্মা সাকাল্লাহু সারাহু ওয়া জায়ালালাল জান্নাতা মাসওয়াহু।
সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর রসুল সা.কে জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রসুল কবরের ওপর কুলবৃক্ষের ডাল ভেঙে পুঁতে দিলেন এর কারণ কী? তদুত্তরে আল্লাহর রসুল সা. বললেন যে, ঐ কবরে মৃত ব্যক্তির ওপর আজাব হচ্ছে, আর তাজা বৃক্ষের ডালটা ঐ কারণে পুঁতে দিলাম যাতে বৃক্ষরাজি, লতাপাতা ও মহান আল্লাহর জিকিরে লিপ্ত থাকে। ঐ গাছের ডাল এবং পাতাসমূহ মহান আল্লাহর জিকির করার কারণে ঐ মৃত ব্যক্তির কবর আজাব লাঘব হবে। মুতাওয়াতির হাদিস অথবা দুর্বল হাদিস হলেও আজাবুল কাবরি হাক্কুন। অর্থাৎ কবরের আজাব সত্য এতে কোনো সন্দেহে নেই।
লেখক: অতিথি অনুবাদক, মক্কা আল মুকাররামাহ ও সাবেক খতিব, জাতীয় সংসদ জামে মসজিদ
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-