রোহিঙ্গা সংকট : আমরা কীভাবে দেখছি, বিশ্ব কীভাবে দেখছে

দেশে ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা আসার ৪ বছর পার হয়েছে। এসব শরণার্থী সমস্যা সমাধান ও মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সুনির্দিষ্ট রেখা দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে ঐ দেশের শাসকদের সম্মতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার খবর নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছিল। চলছিল কয়েক দশক ধরে।

২০১৭ এর আগস্ট এ তারা রাখাইনের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে আবারও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ঐ সময় এই অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশুদের ঢল নামে বাংলাদেশ অভিমুখে। প্রাণ বাঁচাতে মাত্র কয়েক মাসে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগেও নানাভাবে, নানা কারণে রোহিঙ্গারা এদেশে এসেছিল। ঐ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আসার পর মানবিক কারণে সরকার এদের আশ্রয় দেয়। অতীতেও একই কারণে এদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। এই ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা আমাদের মতো দেশের জন্য সহজ কথা না।

আন্তর্জাতিক সম্পদায়ের সাথে নানা দেন দরবার, বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পরও এখনো পর্যন্ত শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব জুড়ে করোনা সংকট, বৈশ্বিক আঞ্চলিক রাজনীতি এবং সর্বশেষ আফগান পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা পিছিয়ে পড়েছে।

মানবিক সহায়তার পাশাপাশি তখনই দেখা যাচ্ছিল যে, দেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, দুর্বৃত্ত চক্র ও অতীতের নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত চক্র রোহিঙ্গাদের নানাভাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতারণের প্রধান কারিগর বলে খ্যাত জেনারেল মিন অং হ্লাইং এখন মিয়ানমারের সেনা প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তন।

২০১৭ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফ ও ঐ সব অঞ্চলে শরণার্থীদের দেখতে ও বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে গিয়ে তাদের দুরবস্থা দেখেছিলাম। একইসাথে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ স্থানীয় সংকটের কথাও বলেছিলেন। মানবিক সহায়তার পাশাপাশি তখনই দেখা যাচ্ছিল যে, দেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, দুর্বৃত্ত চক্র ও অতীতের নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত চক্র রোহিঙ্গাদের নানাভাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

পরে বেশ কিছু প্রমাণও মিলেছে। এরপর সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন বেশ কিছু সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে। দেশের মধ্যে থাকা নানা অপশক্তি, ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারীরা এরপরও সক্রিয় থেকেছে, থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

দেশের উপর পড়া এই সংকট দূর করতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক যে সমাধান আনছে না এ কথা প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। মিয়ানমার যেমন রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তেমনই আঞ্চলিক অন্য দেশ তাদের বাণিজ্য বিস্তারে মিয়ানমারকে অখুশি করতে চায় না। এছাড়া রয়েছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অন্যদের প্রভাব খর্ব করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।

এইসব বিবেচনায় দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে যতই মধুর সুর দেওয়া হোক না কেন বাস্তবে ফলাফল শূন্য। অন্যদিকে বৈশ্বিক বিভিন্ন সম্প্রদায় এদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান, জীবন মান উন্নয়ন ও এদের মানবাধিকার নিয়ে যতটা সক্রিয় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে তার থেকে বেশি নিষ্ক্রিয়। যার যার রাজনৈতিক অবস্থান ও স্বার্থ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এখনতো প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে।

চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনায় প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হওয়ার পরও কার্যকর হয়নি। নানা ভয়ভীতি থাকার পরও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা জনগোষ্ঠী দেশে ফিরতে যে পাঁচ দফা দিয়েছিল তাও মিয়ানমার সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি।

এসব দফার মধ্যে আছে, প্রত্যাবসনের পর সকলকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া, রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং হত্যা ও নির্যাতনকারীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা। এগুলো সবই ন্যায্য।

বৈশ্বিক বিভিন্ন সম্প্রদায় এদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান, জীবন মান উন্নয়ন ও এদের মানবাধিকার নিয়ে যতটা সক্রিয় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে তার থেকে বেশি নিষ্ক্রিয়।

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার কাজ চলমান থাকলেও প্রত্যাবাসনের কাজের কোনো খবর নেই। এভাবে কি চলতে থাকবে? না, এভাবে চলতে থাকা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সুখকর হবে না। ১১ লাখ জনগোষ্ঠীর খাবার ও বাসস্থানের চেয়েও বড় সংকট হলো—এসব জনগোষ্ঠীর অনেকে সমাজের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

বিভিন্ন অপশক্তি এদের ব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পরিবেশ-প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। স্থানীয় মানুষের জীবন মানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সরকার ও দেশবাসীকে এই কাজে অনেক অর্থ, সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। ঐ অঞ্চল ঘিরে বিভিন্ন অপশক্তি তাদের অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে।

সব মিলিয়ে সম্ভবত বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ সংখ্যক শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। যা দেশের চলমান সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ অবস্থায় বিশ্ব ও আঞ্চলিক নানা পরিস্থিতির মধ্যেও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিষয়টি প্রতিনিয়ত আলোচনার মধ্যে জিইয়ে রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার কাজকে এগিয়ে নিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। অন্যতম কাজ হবে, বিগত দিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভূমিকা পর্যালোচনা করে, আন্তর্জাতিক ফোরামে এদের সমর্থন পেতে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক অরাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।

আঞ্চলিক ইস্যু হিসেবে শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বা বিশেষ দেশের উপর নির্ভর করে যে এর সমাধান নেই এটি হিসেবে রেখেই সামগ্রিক কার্যতৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।

সম্প্রতি আফগানিস্তানকে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর এই ইস্যু পেছনে পড়ে গেছে। অথচ আফগানিস্তানের সংকট, রোহিঙ্গা সংকট এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গভীর সংকট তৈরি করতে পারে। তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এই সংকট নিরসনে বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স ।।

সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

মেইল: hossainprince@yahoo.com

আরও খবর