ঐতিহাসিক মানবিকতা, অনিশ্চিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: আবু মোরশেদ চৌধুরী

আজ ২৫ আগষ্ট, একটি ঐতিহাসিক দিন। ২০১৭ সালের এই দিনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমার সরকারের পৈচাশিক নির্যাতন, আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ আর গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ জন্মভূমি ছেড়ে যখন জীবন বাঁচানের জন্য নাফ নদীতে ভাসছিল, তখন কোন রাষ্ট্র মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে নাই।

নিজ দেশের প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকার পরও সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক বিবেচনায় বাস্তুচ্যুত ভাসমান নির্যাতিত মানুষের প্রতি মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সীমান্ত খুলে দিয়ে নজিরবিহীন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।

বিশ্বের ইতিহাসে এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মানুষ নিজ জন্মভূমিতে ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়ে আসার ঘটনা বিরল। সেই দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে উখিয়া-টেকনাফ এলাকার হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ, সুশীল সমাজ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংঘটন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা তাদের যা ছিল, আবাসন, খাদ্য, কাপড় ভাগাভাগি করে রোহিঙ্গাদের সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন।

শুধু তাই নয়, এলাকার বননির্ভরশীল সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী দরিদ্র লোকজন তাদের বিনিয়োগের বাগান ছেড়ে নির্যাতিত মানুষগুলোকে জায়গা করে দেন। এর প্রায় দু’মাস পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে এদেশে রোহিঙ্গা আগমনের মতই আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায়/হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কিছু দিনের মধ্যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে ধীরে ধীরে স্থানীয় জনগণের ধারণাও পাল্টাতে শুরু করেছে ।

রোহিঙ্গা আগমনের কয়েক বছর পর্যন্ত তাদের মায়ানমারে ফেরত নেয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা এবং মায়ানমারের সরকারের উপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেলেও বিগত দু’বছর এর কোন কর্মতৎপরতা খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা যতটা না মানবিক মর্যাদা নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তৎপর, তার চেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাদের ক্যাম্পে অন্যান্য সহযোগিতা করা।

বর্তমানে ছয় হাজারের একরেরও অধিক সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় করে ৩৪ টি ক্যাম্পে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। যদিও ইতোমধ্যে ক্যাম্পে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য কিছু ভাসানচর স্থানান্তরিত হয়েছে।

ইদানিং স্থানীয় জনগণের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করছে যে, আমরা কোন না কোনভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার! ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এত সহজে হচ্ছে না! এখন স্থানীয় জনগন নতুন করে লাভ-ক্ষতি আর আশা-প্রত্যাশার হিসাব কষছেন। জনগণের চিন্তা, অনাগত ভবিষ্যতের পরিবেশ বিপর্যয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, জনসংখ্যা আধিক্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাজার ব্যবস্থাপনা, শ্রমবাজার সর্বোপরী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। অপরদিকে বিগত কয়েক বছর ধরে নুতন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্পভিত্তিক মাদক চোরাচালান, খুন, অপহরণের মত জঘন্যতম কর্মকান্ড!কি হবে আমাদের বা রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত? এর জবাব কি কারো কাছে আছে? রোহিঙ্গারা কি মানবিক মর্যাদা নিয়ে তাদের দেশে আগের মত ফিরে যেতে পারবে? তাদের ফেলে আসা আবাসন, জীবন-জীবিকার মাধ্যমগুলো কি এখনও সুরক্ষিত আছে? নাকি মায়ানমার সরকার বুলডোজার চালিয়ে সমান করে নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করেছে! হ্যা, অনেকটা তাই হচ্ছে ওপারে।

আজ চারটি বছর পার হতে চলছে, আরও কয় বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তা ভাগ্যবিধাতা ছাড়া কেউ জানে না। দৃশ্যপটে মনে হচ্ছে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ দেশে ফেরত না যাওয়া পরযন্ত সরকার কি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোন মেয়াদ ভিত্তিক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন? তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটা অংশ কিন্তু বেকার কর্মহীন যুবসম্প্রদায়।

তারা মূলতঃ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আলস জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাদের নিয়ে স্থানীয় জনগণের দুশ্চিন্তা বেশি, অলস “মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা “।

এদের ক্যাম্পের ভিতরে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন অন্যতায় মাদক, মানবপাচার, খুন অপহরণের মত জগন্য কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে, নারীরা হবে মানব পাচারের শিকার। ক্যাম্পে এদের মায়ানমারের প্রচলিত শিক্ষার দেয়ার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা, শিষ্টাচার বিয়য়েও শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য তাদের দৈনিক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কিছু অংশ যাতে তারা নিজেরা ক্যাম্পে বসে তৈরী করতে পারে- সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে হোস্ট কমিউনিটি আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারি/বেসরকারি/আন্তর্জাতিক মহলের যে কোনো কর্মপরিকল্পনায় স্থানীয় সরকার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সুশীল সমাজ, মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ করা প্রয়োজন। সরকারের কাছে আবেদন, রোহিঙ্গারা ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত অতি দ্রুত সমন্বিত পরিকল্পনা করা।

যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও তৎপর হওয়ার তাগাদা দেওয়া প্রয়োজন।

প্রত্যাবাসন এর ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে মায়ানমারের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ২য় লাইনে বেসরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা (second line of Diplomacy) চালানো যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সাহায্য দিনদিন কিন্তু কমে আসছে। বিশ্বে অন্য কোন জায়গায় অতিমাত্রায় মানবিক বিপর্যয় ঘটলে বিদেশি সংস্থার সাহায়তা হয়তো প্রায় শূন্যের কোটায় চলে আসতে পারে, যা পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলার আশংকা আছে।

তাই বিদেশি সংস্থাগুলোর মানবিক সহায়তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতে মনিটরিং করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা প্রয়োজন , যাতে ভবিষ্যতে যেকোন মানবিক বিপর্যয়কালে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে পারে।

দুর্দিনে এরাই টাইটানিকের ছোট ছোট লাইফ বোট হিসেবে সরকারের সাথে কাজ করবে। সার্বিক বিবেচনায় মনে রাখতে হবে, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির চেয়ে অনেক বিপজ্জনক।

আরও খবর