৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা!

কক্সবাজার জার্নাল ডেস্ক:
সময় যত গড়াচ্ছে, অপরাধপ্রবণতাও তত বাড়ছে কক্সবাজারের ৩৪ ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মধ্যে। খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মাদক পাচার ছাড়াও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মাত্রা গত চার বছর ধরে ক্রমাগত বাড়ছে তাদের ভেতর। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি; আসামি ছিল ১৫৯ রোহিঙ্গা। অথচ চলতি বছর মাত্র ছয় মাসেই ৫৬৭টি মামলায় রোহিঙ্গা আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এদের অনেকে বিপুল অর্থসম্পদের মালিকও হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলা সদরসহ অনেক স্থানে। গত মার্চে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে অপহৃত হয় সাত বছরের শিশু শাহিনা আক্তার আঁখি। তাকে ২৭নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেন এপিবিএন সদস্যরা। একই মাসে মহেশখালী থেকে অপহৃত কিশোর মোহাম্মদ মোজাহিদ মিয়াকে কুতুপালং ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

গত শুক্রবার সকালে টেকনাফের পাহাড়ি ঝরনা ‘স্বপ্নপুরি’তে সংঘটিত ঘটনাটি এর একটি ছোট উদাহরণ। কলেজপড়ূয়া নয়জন ছাত্র গোসল করতে গিয়েছিল সেখানে। এ সময় মুখোশধারী রোহিঙ্গা ডাকাত দল তাদের অস্ত্রের মুখে পাহাড়ি আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে রাখে। পরে মুক্তিপণ আদায় করে এই ছাত্রদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, রোহিঙ্গা ডাকাতদের আতঙ্কে পর্যটনের সম্ভাবনাময় পাহাড়ি ঝরনা স্বপ্নপুরি আর নিরাপদ নয়। তিনি জানান, গত সপ্তাহে আবু সৈয়দ প্রকাশ আবদুল্লাহ (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে পাহাড়ি ছড়ায় পাওয়া যায়।

এর আগে ৯ আগস্ট টেকনাফের ২৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপহরণের এক চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। ওই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদকে (৩০) অপহরণের চেষ্টা চালায় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। কিন্তু টহলরত এপিবিএন সদস্যরা এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। গত জুলাইয়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় অপহৃত দুই ব্যক্তিকে। লেদা ২৪ নম্বর ক্যাম্পের আবুল হোসেন (৬৫) এবং মো. লেয়াকত আলীকে (৫৩) সেখানকার বাজার থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। এ সময় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর এক সদস্যকে আটক করে এপিবিএন।

টেকনাফের দমদমিয়ায় গত ৫ আগস্ট র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুরুল আলম (৪০)। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিদেশি পিস্তলসহ দেশি অস্ত্র ও গুলি। এর আগেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নিহত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে গত চার বছরে খুন হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। তাদের অনেকে খুন হয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতে।
মাদক পাচারকারী গডফাদার ৩২ জন : মাদক পাচার মামলায় মো. হাসান (১৯) নামে এক রোহিঙ্গার সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে গত রোববার। কক্সবাজারের যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে এ রায় দেওয়া হয়। আসামি টেকনাফের হ্নীলা নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে গত ১০ আগস্ট উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়েছে ৮০ হাজার ইয়াবা। আটক হয়েছে রোহিঙ্গা মনসুর আলী (৩০)। এর আগের দিন উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়েছে দুই লাখ ৬৮ হাজার ইয়াবা। এই সময়ে র?্যাবের হাতে আটক হয়েছে দুই রোহিঙ্গা।

কক্সবাজার কারাগার সূত্র জানায়, সেখানকার কারাগারে আটক চার শতাধিক রোহিঙ্গার বেশির ভাগই মাদক মামলার আসামি। মাদক ব্যবসার সুবাদে বিত্তশালী হয়ে এদের কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি ও ফ্ল্যাটও কিনছে এবং এ দেশে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩২ জন মাদক পাচারকারী গডফাদারের সন্ধান মিলেছে। ইয়াবার বড় বড় চালান পাচারে জড়িত তারা। সম্প্রতি কক্সবাজারের চৌফলদন্ডি উপকূল থেকে ধরা মাদকের বিশাল চালান প্রচেষ্টায়ও এই গডফাদাররা জড়িত। পুলিশ সুপার বলেন, বড় পাচারকারীদের ছত্রছায়ায় থেকে ক্যাম্পের আরও অনেকেই এই ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। অভিযানে যারা ধরা পড়ছে, তারা তো বহনকারী। আমরা চেষ্টা করছি রোহিঙ্গা গডফাদারদের ধরার।

কেবল মাদক পাচার নয়, স্বর্ণ পাচারেও জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। গত সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম কোনারপাড়া শূন্যরেখা থেকে জয়নুল আবেদীন (৫৫) নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪৭০ ভরি ওজনের ৩৩টি স্বর্ণবার।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২৯৮ মামলা : জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছেন দুই হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশ আক্রান্ত ইত্যাদি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭০টি খুনের মামলা হয়েছে গত চার বছরে। এই সময় ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি। আসামি ছিল ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি। যার আসামি ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় হয়েছে ৪৪৯ আসামি। চলতি বছরের ছয় মাসে ৫৬৭ মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা : কক্সবাজারের রামুতে গত এক মাসে ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সময় ৪৭৫ রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিগ্যান চাকমা জানান, কঠোর লকডাউনের সময় রামুর বিভিন্ন পয়েন্টে তলল্গাশি চৌকি বসানো হয়। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা আটক হয়। জরিমানা করে তাদের আবারও টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সুনীল বড়ুয়া বলেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হলেও মাত্র চার বছরে এরা বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের হাতে স্থানীয় অনেকে খুনও হয়েছেন। তারা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। কক্সবাজার শহর এবং আশপাশের এলাকায় অবৈধ বসবাসকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা অর্ধলাখ।

এনআইডি ও পাসপোর্ট রোহিঙ্গাদের হাতে : টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাং পুটিবনিয়ার ২২ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা মো. তৈয়ব (২৮)। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু ঝিমংখালী এলাকার আবু শামা ও ফাতেমা খাতুনের ছেলে সে। তার রয়েছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট। এ দেশের জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মো. খালেদ হোসেন। তবে বাবা-মায়ের নাম ঠিকই রয়েছে। পাসপোর্ট আর জাতীয় পরিচয়পত্রে তার ঠিকানা চট্টগ্রামের হালিশহর। গত ১৪ জুলাই রাতে এপিবিএনের সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাকে আটক করে।
এপিবিএন ১৬-এর অধিনায়ক এসপি তারিকুল ইসলাম জানান, মো. তৈয়ব অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছে। তাকে ক্যাম্প জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তাজ বিল্লাহ বলেন, গত এক বছরে কক্সবাজার থেকে কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট করতে পারেনি। তৈয়বের হাতে থাকা পাসপোর্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ইস্যু করা হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।

পাসপোর্ট অফিস, পুলিশ ও দুদক সূত্র অনুযায়ী, তৈয়বের মতো প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গার কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র রয়েছে। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর টেকনাফ জাদিমুরা ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের পাহাড়ে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ। তার কাছে পাওয়া গেছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র। এ ঘটনার তদন্তের সময় জানা যায়, ২০১৫ সালের হালনাগাদ ভোটার তালিকায় ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

স্থানীয়দের ‘আতঙ্ক’ রোহিঙ্গা : টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে আতঙ্ক। তারা মাদক ও মানব পাচার, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ, খুনসহ নানা অপকর্ম করছে। ভাড়াটে খুনি এবং অপহরণকারী হিসেবেও কাজ করছে।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা যেভাবে অপরাধে জড়িত হচ্ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। যেভাবেই হোক এদের দ্রুত মিয়ানমার ফেরত পাঠানো দরকার।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন বেপরোয়া। বিভিন্ন দাবিতে তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভও করছে। টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এদের উস্কানি দিয়েছে। তবে প্রশাসন শক্ত অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামসু-দ্দৌজা।
সূত্র: সমকাল

আরও খবর