জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করল পরীমণি

আলোচিত নায়িকা পরীমণির বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় মাদকদ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিয়েছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। এর আগে বুধবার (৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় বনানীর বাসা থেকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য দিয়েছেন তিনি।

তবে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিজের ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত এই চিত্রনায়িকা কান্নাকাটিও করেছেন। বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকাল থেকে আবারও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়ে এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে বিপুল অর্থ আয় করেছেন এই অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ এবং মিশু হাসান নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে পরীমনি অর্থের ‘মোহে ডুবে যান’ বলে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পরীমণির বিরুদ্ধে একটি মাদক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। বনানী থানায় এই মামলা দায়ের করা হবে।

র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, বুধবার বিকালে অভিযানের সময় পরীমণির বাসায় প্রবেশ করা নিয়েই অনেক জটিলতা তৈরি হয়। তিনি ভেতর থেকে বাসার দরজা খুলছিলেন না। প্রায় আধঘণ্টা পর দরজা খুলে দিলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল তার বাসায় প্রবেশ করে। পরীমণি প্রথমে র‌্যাবের গোয়েন্দা দলের কাছে উচ্চ পর্যায়ে তার অনেক যোগাযোগের কথা বলেন। পরে তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, আইস ও এলএসডি মাদক উদ্ধারের পর চুপসে যান তিনি। এরপর আভিযানিক দলের সদস্যদের সহযোগিতা করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, আটকের পর পরীমণিকে সোজা উত্তরার র‌্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা তাকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে পরীমণি কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তার সঙ্গে উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কার কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে- তা অকপটে বলতে শুরু করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবের কর্মকর্তারা তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন, বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস এবং কিছুদিন আগে বোট ক্লাবে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের অভিযোগ সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। কোনও কোনও প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ ছিলেন পরী। তবে বেশিরভাগ সময়ই কান্নাকাটি করেছেন। পরী বলেছেন, তিনি ভাবতেও পারেননি তার বাসায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাতে পারে কিংবা তাকে এভাবে মাদকদ্রব্যসহ আটক করা হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযানের সময় পরীমণি জনৈক সম্পদ (ব্যক্তির নাম) ও পুলিশের একজন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন। তাদের সঙ্গে পরীমণির কী সম্পর্ক সেটাও জানার চেষ্টা করছে। এছাড়া তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কথিত প্রযোজক ও রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজের বাসায় অভিযান চালানো হয়।

বিপুল অর্থ পেতে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতেন পরীমনি

র‌্যাব সূত্র বলছে, বুধবার গ্রেফতার হওয়া মিশু নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল পরীমণির। মিশু মূলত বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করে পরীমণিকে নিয়ে যেতো। এছাড়া রাজও প্রথমদিকে পরীমণিকে উচ্চবিত্ত বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেসব ব্যক্তির সঙ্গে ‘বিশেষ সঙ্গ’ ও পার্টিতে অংশ নিয়ে অর্থ আয় করতেন পরী। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এরকম ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির নামও প্রকাশ করেছেন।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরীমণিকে সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখার একটি কক্ষে রাখা হয়। সেখানে তার সঙ্গে একাধিক নারী র‌্যাব সদস্যরা পাহারায় ছিলেন। সারারাত ঘুমাননি পরীমণি। রাতভর কান্নাকাটি করেছেন তিনি।

এদিকে র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, পরীমণির সহযোগী নজরুল রাজের বাসা থেকে সিসা খাওয়ার উপকরণসহ বিকৃত যৌনাচারের বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদক ও পর্নোগ্রাফি আইনে পৃথক মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও একটি মামলা হতে পারে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা।

এর আগে বুধবার বিকালে হঠাৎ করেই পরীমণি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লাইভে এসে ‘বাসায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা’ দরজা ধাক্কাধাক্কি করছেন বলে অভিযোগ করেন। পরে জানা যায়, র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল তার বাসায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানে গিয়েছেন। বিকাল পাঁচটা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা নাটকীয় অভিযানের পর পরীমণির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, আইস ও এলএসডি মাদক উদ্ধারের দাবি করে র‌্যাব। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনও কিছু জানানো হয়নি।

সূত্রগুলো জানায়, র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন পার্টি, তাদের আয়োজক ও কয়েকজন বিতর্কিত সেলিব্রেটির কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় একটি সিন্ডিকেটের তথ্য পায় তারা। যে সিন্ডিকেটে পরিচিত সেলিব্রেটিসহ, উঠতি মডেল এমন অনেক নারী জড়িত। তারা সবসময় মাদকের সংস্পর্শে থাকে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে নানা সময় ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা হাতানোর মত কাজও করেছে। সেই সঙ্গে তাদের নিজেদের উৎশৃঙ্খল আচরণের কারণেও কাউকে কাউকে নজরদারিতে আনে র‌্যাব।

স্মৃতি থেকে পরীমনি, উত্থান যেভাবে

বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে গতকাল চিত্রনায়িকা পরীমনিকে আটক করেছে র‍্যাব৷ পরীমনির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে মাদক দ্রব্য ও মদ পাওয়া গেছে৷ এ ঘটনা এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি। এবার জেনে নেয়া যাক, আলোচিত এই নায়িকার উত্থান হয় কীভাবে। পরীমনির আসল নাম ছিল শামসুন্নাহার স্মৃতি।
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে রাজধানীতে আসেন সাতক্ষীরার এই তরুণী। লক্ষ্য ছিল শোবিজ জগতে কাজ করা। শুরুতে মডেলিং দিয়ে শুরু হয়েছিল তার পথচলা। এরপর আসে নামের পরিবর্তন। নাম হয় পরীমনি।
এরপর বেশকিছু টিভি অনুষ্ঠান ও নাটকে কাজ করেন। তবে একের পর এক সিনেমায় যুক্ত হয়ে লাইমলাইটে আসেন। ২০১৫ সালে মুক্তি পায় পরীমনি অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘ভালোবাসা সীমাহীন’। ওই সিনেমা মুক্তির আগেই তিনি প্রায় ২৩টি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন! যেকোনো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির নায়িকাদের ক্ষেত্রেই এটি বিরল। যদিও সবগুলো সিনেমা শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলো দেখেনি।

‘ভালোবাসা সীমাহীন’ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরীমনি আলোচনায় আসেন ‘রানা প্লাজা’ সিনেমার মাধ্যমে। কেবল ২০১৫ সালেই তার এক ডজন সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। রাতারাতি ঢালিউডের তারকা বনে যান তিনি। সেই সঙ্গে তার হাতে আসতে থাকে নতুন নতুন সিনেমার কাজ আর কাড়ি কাড়ি অর্থ। শুরু হয় তার বিলাসবহুল জীবন।

মূলত সিনেমায় পরীমনির জনপ্রিয়তা বাড়ে ২০১৬ সালে। ওই বছর মুক্তি পায় জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত সিনেমা ‘রক্ত’। সেখানে বেশ সাহসী চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক আলোচিত হন তিনি। এর পরের বছর ‘অন্তর জ্বালা’ সিনেমায় কাজ করেও প্রশংসিত হয়েছিলেন এ নায়িকা।

তবে পরীমনির ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রশংসিত সিনেমা ‘স্বপ্নজাল’। যেটি নির্মাণ করেছেন ‘মনপুরা’ খ্যাত গিয়াসউদ্দিন সেলিম। এটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে। এরপর তার অভিনীত কোনো সিনেমাই খুব একটা দর্শকপ্রিয়তা পায়নি।

আরও খবর