শাহাদাত হোসেন পরশ, সমকাল •
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার এক এলাকা থেকেই ক্যাম্প পালানো ১৮৩ রোহিঙ্গা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছেন। বিভিন্ন সময় একাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টেকনাফ শহরে এসে পরিবার-পরিজনসহ তারা বসতি গেড়েছেন।
টেকনাফ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যাম্প ছাড়া এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাসের বিষয়টি গতকাল রোববার সামনে আসার পর স্থানীয় সচেতন মহলও বিস্মিত। একই সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ
করেছেন। যেভাবে একটি ওয়ার্ডে এত সংখ্যক রোহিঙ্গার বসবাসের বিষয়টি সামনে এলো তাও কাকতালীয় এবং অভিনব। বাঙালির সঙ্গে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা করে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার এই কাজটি করা হয়েছে একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এরপর এই তালিকা গতকাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর অনুলিপি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কাছেও পাঠানো হয়। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. পারভেজ চৌধুরী বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে পলাতক রোহিঙ্গাদের যে তালিকা করে আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এটা সাধুবাদ পাওয়ার মতো কাজ। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছি। যারা এই তালিকা তৈরি করেছেন তারা আগে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা চেয়েছেন। তাদের বলা হয়েছে, যেহেতু আপনাদের কাছে তথ্য রয়েছে কাজটি আপনারাই করুন।
তিনি আরও বলেন, রেজিস্টার্ড ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালালে তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিজ ক্যাম্পে ফেরত দেওয়া হয়। আমরা অনেক সময় দিয়েও থাকি। টেকনাফ পৌরসভায় বসবাস করা রোহিঙ্গাদের যে তালিকা পেয়েছি এ ব্যাপারে আমরা কাজ করব।
স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার সঙ্গে সংযুক্ত টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, কয়েকদিন আগে টেকনাফ শহরে হাঁটার সময় দুই নারীর কথোপকথন কানে আসে। এরপরই তাদের রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা নিজেদের রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেন। পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তারা বসবাস করছেন বলে জানান। কীভাবে ক্যাম্প থেকে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরে তারা এলেন এমন প্রশ্ন করলে নিরুত্তর ছিলেন তারা। তখনই মাথায় আসে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে এটা বের করতে হবে। প্রথমে নিজের ওয়ার্ড ৫ নম্বরে ব্যক্তি উদ্যোগে কাজটি শুরু করি।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করতে একটি কৌশল নিই। এলাকায় ঘোষণা দিই চলমান বন্যা ও ভূমিধসের পর একটি এনজিওর পক্ষ থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। এটা জানার পর রোহিঙ্গাদের অনেকে স্বেচ্ছায় এসে তাদের নাম-পরিচয় জানান। এত সংখ্যক মিয়ানমারের নাগরিক ক্যাম্পের বাইরে এসে বসবাস করছে এটা বিস্ময়কর।
তবে টেকনাফ পৌরসভার সব ওয়ার্ড এবং আশপাশ এলাকায় খোঁজ নিয়ে আরও শত শত রোহিঙ্গা পাওয়া যাবে, যারা স্থানীয়দের সঙ্গে বসবাস করছেন। দ্রুত তাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের যারা ভাড়া দিয়েছেন এমন একাধিক বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের একজন হলেন মো. আরিফ।
তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম থাকি। টেকনাফে আমার বাসার নিরাপত্তারক্ষী ২ রোহিঙ্গা পরিবারকে বাসা ভাড়া দেয়। এক পরিবার তিন মাস আগে আসে। আরেক পরিবার এক মাস ধরে থাকছে। বাসা ভাড়া কম হওয়ায় নিরাপত্তারক্ষীও ভাড়াটিয়াদের পরিচয় সম্পর্কে খুব বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। ভাড়াটিয়া নাকি আশপাশে লেবার হিসেবে কাজ করত। রোহিঙ্গা জানার পর দু-চার দিনের মধ্যে তাদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে দিয়েছি।’
আয়ুব খান নামে আরেক বাড়ির মালিক বলেন, ‘তিন মাস ধরে একটি রোহিঙ্গা পরিবার আমার বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে রয়েছে। দু-তিন আগে তারা রোহিঙ্গা এটা নিশ্চিত হই। বাসায় ওঠার সময় তাদের কাছে কাগজপত্র দেখেনি। এখন ওদের বাসা ছাড়তে বলে দেব।’
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেওয়া পত্রে বলা হয়, ‘দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গারা টেকনাফ পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করায় সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থার দেওয়া ত্রাণসামগ্রী ক্যাম্পে গিয়ে তারা গ্রহণ করছে। আবার ক্যাম্প থেকে ফিরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে অবাধে যাতায়াত করছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প মাদকের আখড়া। ক্যাম্পের মাদক রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে অবাধে চলে আসে। করোনা সংক্রমণ, অসামাজিক কার্যকলাপ, চুরি-ডাকাতি বিবেচনায় টেকনাফবাসীকে মুক্ত করতে অনুরোধ করা হয়।’
তালিকায় যারা :ক্যাম্প ছেড়ে যেসব রোহিঙ্গা টেকনাফ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করছেন তারা হলেন জাহেদা বেগম। তার স্বামী মকবুল হোছন। ৫ ছেলেমেয়ে ইয়াছিন আকতার, সামিনা আকতার, মো. আয়েতুল্লাহ, মো. জুবায়ের, বাজুমা বেগমসহ জাহেদা বর্তমানে পৌরসভার আলিয়াবাদ এলাকায় ছৈয়দ কাশিমের জায়গায় বসবাস করছেন। জাহেদা ছিলেন থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৮ নম্বর ব্লকে। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্পের শাহাজার। তার স্বামীর নাম রশিদ আহমেদ। তারাও পৌরসভার আলিয়াবাদে থাকছেন।
অন্যরা হলেন- নবী হোছনের স্ত্রী জোহর বাহার, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী হাসিনা বেগম, পেঠান আলীর স্ত্রী জাবেদা, মৃত জহুর আলমের স্ত্রী মিনারা বেগম, গোলাম ছৈয়দুর রহমানের ছেলে মো. আলম, হাসিনা বেগম, ইউছুপ আলীর মেয়ে পারভীন ও তার দুই ছেলে রিফাত ও আরাফাত। পৌর আলিয়াবাদ এলাকায় আলী হোসেনের বাসায় ভাড়া থাকছেন ক্যাম্প পালানো নবী হোসেন ও তার স্ত্রী খতিজা বেগম এবং তাদের চার ছেলেমেয়ে মোবারাক হোছন, নূর হোছন, সেতারা বেগম ও সেনুয়ারা বেগম। একই এলাকায় জহিরের বাসা ভাড়া নেওয়া রোহিঙ্গারা হলেন মো. হাশেম ও তার স্ত্রী রমিদা বেগম এবং তাদের পাঁচ ছেলেমেয়ে মো. রাসেল, আরিফ, তাসলিমা, আব্দুল্লাহ ও মো. শরীফ। পৌরসভার আয়ুব খানের বাসায় বসবাস করছেন জমিলা খাতুন ও তার স্বামী মো. আরিফ। তাদের সঙ্গে চার ছেলেমেয়ে আছেন।
তারা হলেন আখতার ফারুক, মো. আরাফাত, রিফা আকতার ও ইয়াছিন আরাফাত। পৌর এলাকার মোস্তাকের বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছেন চার রোহিঙ্গা। তারা হলেন ধলা বানু ও তার স্বামী আনোয়ার এবং তাদের দুই ছেলেমেয়ে। তারা হলেন মো. আয়েজ ও ফরোয়াছ বেগম। ইসহাকের বাড়িতে আছেন ছালেমা বেগম ও তার স্বামী মো. ফারুক। তাদের চার ছেলেমেয়ে ওমর ফায়সেল, ফাহিমা, মো. ফাহিদ ও তামিমও তাদের সঙ্গে বসবাস করছেন।
তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোছনি ব্লকের। তাদের মাঝির নাম মো. মাছন। নুরুল ইসলামের বাড়িতে বসবাস করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার স্বামী রহমত উল্লাহ। তাদের ছেলেমেয়ে আবু বক্কর ছিদ্দিক ও আয়েছা ছিদ্দিক তাদের সঙ্গে রয়েছেন। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাইংখালী ১৫ নম্বর ব্লকের। ক্যাম্প ছাড়ার তালিকায় আছেন নুরুল আমিন, মো. হাছন, মো. ওমর, ওমর ছাদেক, রুশমি আক্তার, জমিলা, আজিজা খাতুন, মো. রিয়াজ, নুর কবির, মো. জোনায়েদ, খালেদা বেগম, মো. নয়ন, আসমা খাতুন, মো. ছিদ্দিক, খালেদা বেগম, রুবেল, তাসলিমা, রিফা মনি, ছে মং, হাজেরা খাতুন, আবু বকর ছিদ্দিক, মো. রশিদ, জামাল, ছায়েরা খাতুন ও সায়েদ।
তারা সবাই পৌর এলাকার দিল মোহাম্মদ, আকতারুজ্জামান, ইসমাইল ও কবিরের বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন। পলাতক রোহিঙ্গার তালিকায় আরও আছেন চাকমার কুল পালংখালী ক্যাম্প এবং মোছনি ব্লকের মাজেদা, ইসমাইল, ইউছুফ, আমিন, আনোয়ারা, উম্মে কিয়াছ, মো. হোবায়েত, নুরুল হক, নমিনা খাতুন, করিম উল্লাহ, সাহেদা বেগম, নুর কায়েদা, মোহাম্মদ, মাহামুদা, আয়েশা, ছফুরা, হোছন, আজিজা খাতুন, জাহাঙ্গীর আলম, মো. আলম, নুরুল আলম, রেহেনা বেগম, রোজিনা, রুবিনা, আসমা বিবি, ছেনুয়ারা, ইসরাত ফাতেমা, ফয়েজ, আসমা, রফিক ও নূর কায়দা বেগম। তারা টেকনাফ পৌরসভার জনৈক আরিফ, সেলিম ও হাছানের বাসায় বসবাস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, যাদের বাসায় রোহিঙ্গারা বসবাস শুরু করেছেন, তাদের অনেকে মাদক কারবারে সংশ্নিষ্ট। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় ইয়াবা কারবার আরও বিস্তৃত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডাকাতি, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধে যারা জড়িত, তাদের অনেকেও ক্যাম্প ও পাহাড়ের পলাতক জীবন ছেড়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকে জেনেশুনেই রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়। অনেকে পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশি পাসপোর্টও নিয়েছে। ২০১৯ সালের মে মাসে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকা থেকে অন্তত ১৯ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। তাদের অধিকাংশ ছিল নারী। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ‘বিক্রি’ করার চেষ্টা করছিল একটি চক্র।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-