কোনো ব্যক্তি আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্য হলে ইসলামের বিধান অনুসারে তার উপর হজ পালন করা অবশ্য কর্তব্য। বস্তুত হজ ইসলামী শরীয়তের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ও রুকন।
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদিসে রয়েছে, নবীজি (সা.) বলেন, পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের ভিত্তি: শাহাদত বা আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল- একথার সাক্ষ্য দেয়া, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, রমজানের রোজা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে বায়তুল্লাহর হজ করা। (সহিহ বোখারি: ৮, সহিহ মুসলিম: ১৯)
প্রিয় নবী (সা.) একাধিক হাদিসে আমাদের হজের গুরুত্ব, সওয়াব ও উপকারিতা বুঝিয়েছেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি বলেন, ‘জান্নাতই হচ্ছে মকবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান।’ (সহিহ বোখারি: ১৭৭৩, সহিহ মুসলিম: ৪৩৭)
তবে যাদের হজে অথবা ওমরায় যাওয়ার সামর্থ্য ও সক্ষমত নেই, তাদের জন্যও দয়াবান আল্লাহ এমন কিছু পথ বের করে দিয়েছেন; যেগুলো দ্বারা দুর্বল বান্দারা মকবুল হজের অথবা ওমরাহর সওয়াব পেয়ে যেতে পারে। প্রিয় নবী (সা.) আমাদের সেসব রকমারি পথ বা আমল বাতলিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন হাদিসে। সেসব হাদিসের কোনোটা সহিহ বোখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজি কিংবা অন্য কোনো হাদিসগ্রন্থে অকাট্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে আবার কোনোটা ওই মানের না হলেও জয়িফ কিংবা মওজু নয়, পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেগুলোকে হাসান বলা হয়। অতএব আমরা যদি বিশ্বাস এবং সওয়াবের দৃঢ় আশ্বাস নিয়ে এসব আমল করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ অনেক বিরাট প্রতিদানের অধিকারী হতে পারবো।
এক. সকাল-সন্ধ্যার জিকির করা
আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আমরা একবার রাসূল (সা.)-কে বলি, হে আল্লাহর রাসূল! ধনী ব্যক্তিরা সওয়াবের ক্ষেত্রে আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা হজ করেন, আমরা হজ করি না।
তারা সংগ্রাম-যুদ্ধে শরিক হন, আমরা শরিক হতে পারি না। আরো আরো…।
তখন রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন আমালের কথা বলবো যেটা তোমরা করলে তোমরা তারা যে আমল করে তারচেয়ে বেশি সওয়াব পাবে? আর সেটা হলো- প্রতি নামাজের পর তোমরা ৩৪ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ও ৩৩ আলহামদুল্লিাহ পড়। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং: ১১১৫৪)
দুই. জামাতে নামাজ আদায় করা
আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করলো, সে যেন হজ করে আসলো। আর যে ব্যক্তি নফল নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেলো, সে যেন ওমরাহ করে আসলো। ’ (তাবারানি, হাদিস নং: ৭৫৭৮)
তিন. ইশরাকের নামাজ পড়া
ফজরের নামাজ আদায়ের পর মসজিদে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে বসে আল্লাহর জিকির করলো, এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করলো, সে ব্যক্তি হজ ও ওমরাহর সওয়াব নিয়ে ফিরলো। ’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ৫৮৬)
পবিত্র মসজিদুল হারামের নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক আবহপুর্ণ দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
চার. ফরজ নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়া
আবু উমামা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজের ঘর থেকে ওজু করে (মসজিদের দিকে) বের হয়, সেই ব্যক্তির সওয়াব ইহরাম বাঁধা হাজির মতো হয়। ’ (আহমাদ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২১২; আবু দাউদ, হাদিস নং: ৫৫৮; তারগিব, হাদিস নং: ৩২০)
পাঁচ. দ্বীন শেখা বা শেখানোর উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করা
হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো কথা শিখা বা শিখানোর উদ্দেশ্যে মসজিদে গেল, সে পরিপূর্ণরূপে হজ আদায়কারী ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে। ’ (তাবারানি, হাদিস নং: ৭৪৭৩)
ছয়. রমজানে ওমরাহ পালন করা
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানে ওমরাহ আদায় করলে আমার সঙ্গে হজ আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ১৭৮২; মুসলিম, হাদিস নং: ২২২)
সাত. মসজিদে কুবায় নামাজ আদায়
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে পবিত্রতা অর্জন করল, তারপর মসজিদে কুবায় এসে কোনো নামাজ আদায় করল, সে ওমরাহর সওয়াব হাসিল করল। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং: ১৪১২)
আট. জুমার নামাজ
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ঘর থেকে উত্তমরূপে অজু করে ফরজ নামাজের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে ইহরাম বেঁধে হজে গমনকারীর মতো সওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি শুধু সালাতুদ্দুহা (পূর্বাহ্নের নামাজ) আদায়ের উদ্দেশ্যে কষ্ট করে বের হয়, সে ওমরাহ আদায়কারীর মতো সওয়াব লাভ করবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং:৫৫৮)
নয়. পিতা-মাতার সেবা ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বললো, আমি জিহাদে-সংগ্রামে অংশ নিতে চাই, কিন্তু আমার সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা নেই। তখন রাসূল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার মাতা-পিতার কেউ কি জীবিত আছেন?’ লোকটি বলল, আমার মা জীবিত। তখন রাসূল (সা.) বললেন, ‘তাহলে মায়ের সেবা করে আল্লাহর নিকট যুদ্ধ-সংগ্রামে যেতে না পারার অপারগতা পেশ কর। এভাবে যদি করতে পার এবং তোমার মা সন্তুষ্ট থাকেন তবে তুমি হজ, ওমরাহ এবং যুদ্ধ-সংগ্রামের সওয়াব পেয়ে যাবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং মায়ের সেবা করো। ’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ, হাদিস নং: ১৩৩৯৯)
দশ. ঈদের নামাজ
বিভিন্ন বর্ণনায় সাহাবায়ে কিরাম বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতরের নামাজ ওমরার সমতুল্য এবং ঈদুল আজহার নামাজ হজের সমতুল্য।
এগারো. মুসলমানের প্রয়োজন মেটানো
হাসান আল-বসরি (রহ.) বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটানো তোমার বারবার হজ করার থেকে উত্তম।’
হজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য-সংহতি ও সাম্যের সসুজ্জ্বল নিদর্শন। হজে আর্থিক ও কায়িক শ্রমের সমন্বয় রয়েছে, অন্য কোনো ইবাদতে যা একসঙ্গে পাওয়া না। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ পবিত্র হজ পালনে সৌদি গমন করেন। সেখানে তারা আল্লাহপ্রেমের পাঠ চুকিয়ে রাসুলপ্রেমের ষোলকলা পূর্ণ করেন।
হজের সওয়াব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর মকবুল হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৬)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই কাজগুলোর মাধ্যমে হজের সমপরিমাণ নেকি অর্জনের পাশাপাশি হজ আদায়ের যাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-