সৌদি আরবের চাপে সেই ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার মেয়াদোত্তীর্ণ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ মিশনকে অনুমতি দেওয়ার জন্যও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পরিপত্র জারির নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, শিগগিরই এ বিষয়ে জারি করা পরিপত্র সৌদি আরবে বাংলাদেশ মিশনে পাঠানো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি চাপ মোকাবিলায় আরও কৌশলী পদক্ষেপ না নিয়ে সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করা হলে তা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ভুল বার্তা দিতে পারে। একই সঙ্গে সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কীভাবে পাসপোর্ট পেয়েছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যদি একবার দেওয়া পাসপোর্ট বৈধ হয়, তাহলে সেটি নবায়ন করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য প্রথমবার পাসপোর্ট দেওয়ার আগে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
২০১৯ সাল থেকে এই ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল সৌদি সরকার। এমনকি ২০২০ সালের জুলাই মাসে একটি নোট ভারবালে সৌদি সরকার এই ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত না নিলে সে দেশে কর্মরত অন্যান্য বাংলাদেশি নাগরিককেও ফেরত পাঠানোর হুমকি দিয়েছিল।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ উদার মানবিক দৃষ্টির পরিচয় হিসেবে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে সৌদি আরবে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা নানা কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পায় বাংলাদেশ মিশন থেকে। সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে ভ্রমণও করে। এমন তথ্যপ্রমাণও সৌদি সরকার বাংলাদেশকে সরবরাহ করে। তবে তারা কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়েছিল তার তদন্ত কখনও হয়নি।
যে সিদ্ধান্ত এসেছে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে : গত ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু থেকে দেখা যায়, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, তার সৌদি আরব সফরকালে বাংলাদেশ সরকার ৫৫ হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী কথিত রোহিঙ্গাদের বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে বলে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধারণা দেন। এ ছাড়া ওই ব্যক্তিদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের সঠিক তথ্য বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানোর জন্যও সৌদি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ১৯ জন এমআরপিধারী কথিত রোহিঙ্গাদের জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে উপস্থিত করা হয়। সেখানে যাচাই করে এমআরপিগুলোর বৈধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় তারা। ফলে ওই এমআরপিধারীদের পাসপোর্ট নবায়ন না করার কোনো সুযোগ নেই।
আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পশ্চিম এশিয়া) আরও জানান, সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ১০৯ জনের এমআরপি নম্বর সংবলিত একটি তালিকা জেদ্দাস্থ কনস্যুলেটে পাঠিয়েছে, যার মধ্যে ১৯ জনকে সশরীরে হাজির করতে সক্ষম হয়েছে।
তাদের মধ্যে ১৭ জনের ভিসা বা আকামাতে নাগরিকত্ব মিয়ানমার উল্লেখ আছে, যা তারা মূলত সৌদি সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের জন্য প্রদত্ত কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য করে থাকতে পারে। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেক বাংলাদেশি নিজেকে রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দিয়ে আকামা নিয়েছে বলেও জানা যায়। তাই সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন এমআরপিধারীদের পাসপোর্ট নবায়ন সংক্রান্ত পূর্ববর্তী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরও বর্তমান সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, পুলিশের বিশেষ শাখা এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা শাখার প্রতিনিধিরা।
আলোচকদের একজন বলেন, সৌদি আরবে এই ৫৫ হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীর বিষয়টি জটিল বিধায় এটির কূটনৈতিক স্পর্শকাতরতা দেখা দিতে পারে। তাই পররাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে অন্য সব দপ্তরকে একত্রে নিয়ে বিষয়টি সুরাহা করা উচিত। অপর একজন আলোচক বলেন, সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিলে ভবিষ্যতে তারা বাংলাদেশে আসবেন না মর্মে একটি চুক্তি হতে পারে। একই সঙ্গে তাদের পাসপোর্টে বিশেষ কোনো প্রতীক সংযোজন করা থাকলে তাদের পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত করা সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সবার আগে দেখা দরকার, যারা রোহিঙ্গা পরিচয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিল তারা কীভাবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়েছে। তাদের পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া কী ছিল এবং সেটি বৈধ ছিল কিনা। এখন সৌদি চাপ মোকাবিলায় আরও কৌশলী পদক্ষেপ না নিয়ে তাদের পাসপোর্ট নবায়ন করা হলে তা ভুল বার্তা দিতে পারে। এ কারণে তাদের আপাতত বাংলাদেশি ট্রাভেল পারমিট ও ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে সৌদি আরবে রাখা যায় কিনা সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো যেতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, যদি কেউ প্রথমবার পাসপোর্ট পাওয়ার পর সেটি বৈধ বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তার পাসপোর্ট নবায়ন করাটা আইনি বাধ্যবাধকতা। কারণ বৈধ পাসপোর্টধারীদের পাসপোর্ট নবায়ন নাগরিক অধিকার। যদি কেউ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কিংবা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হয় তাহলেই কেবল পাসপোর্ট নবায়ন না করার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া এই ইস্যুতে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-