বাংলা ট্রিবিউন •
দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ইয়াবা। অন্য যে কোন মাদকের চেয়ে এটি সহজলভ্য, সহজে বহনযোগ্য। এমনকি ইদানিং অনলাইনেও ইয়াবা কেনা যায়, এর হোম ডেলিভারিও হয়ে থাকে। মাদক নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদকসেবনকারীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ইয়াবাসেবীদের সংখ্যা। তাদের মতে, ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না মূলত গডফাদারদের ধরতে না পারার কারণে। আর এই ইয়াবার কারণে ঘটছে নানা ধরনের অপরাধ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখের উপরে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই ইয়াবাসেবী। ইয়াবার জনপ্রিয়তা বর্তমানে এতটাই বেশি যে, সংশ্লিষ্টদের মতে এর চাহিদা কমাতে না পারলে যতই সাঁড়াশি অভিযান চালানো হোক না কেন, কার্যত কোন ফল আসবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাদকসেবী তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, আড্ডা ও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শুরুতে টুকটাক সিগারেট টানাতাম। কিছুদিন পর আরও কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিছক কৌতূহল থেকেই ইয়াবা সেবন করি। তারপর থেকেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ি। এই নেশার কারণে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন হয় যে, ইয়াবা না নিলে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা হতো। এভাবে একসময় প্যাথিড্রিন নেওয়াও শুরু করি। মাঝে কিছুদিন নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর কিছুটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বর্তমানে ঘন ঘন সেবন না করলেও মাঝে মাঝে এখনো পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের অগোচরে সেবন করি। চাইলেই পাওয় যাচ্ছে। এছাড়া ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজের মাধ্যমে ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে ইয়াবা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে মাদকসেবীদের মধ্যে যুবসমাজের সদস্যই বেশী, প্রায় ৮০ শতাংশ। এদের মধ্যে তরুণীদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। নারী মাদকসেবীদের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
এথেনা লিমিটেড মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ডা. ইফতেখার সিদ্দিকী শোভন বলেন, মাদকে আসক্তদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। এদের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়লে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাদের পরিবার। তখন তাদের দুর্ভোগের কোন সীমা থাকে না।
মাদক ও ধূমপান বিরোধী সংগঠন মানস এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডাক্তার অরূপ রতন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৫ বছরের উপরের তরুণদের মাঝে মাদকের প্রতি আসক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে কিশোর গ্যাং দেখা যাচ্ছে, এদের বয়স ১২ থেকে ২০ এর মধ্যে, এরা প্রায় সবাই মাদকে আসক্ত। গ্যাং কালচার এদেরকে মাদকের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। ছেলে কিংবা তরুণদের পাশাপাশি মেয়েদের মধ্যেও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ইয়াবা সেবনের প্রবণতা। শরীরকে চাঙ্গা রাখতে ইয়াবার চাহিদার বিষয়টি বেশি দেখা যায়। যে হারে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে, মাদকের ভয়াবহতা বন্ধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে মাদকসেবীদের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোথেরাপি বিভাগের কাউন্সেলর নুসরাত সাবরীন চৌধুরী বলেন, মাদকে আসক্ত হয়ে যারা সেবা নিতে আসেন, তাদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তই বেশি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, কৌতূহলবশত তারা প্রথমত এই দিকে ঝোঁকে। তাছাড়া আমাদের এখানে এই বয়সীদের জন্য রিক্রিয়েশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাও এধরনের মাদকে আসক্ত হওয়ার একটা কারণ হতে পারে। সন্তানদের মাদকের মরণনেশা থেকে দূরে রাখতে, পরিবারকে সব সময় সাবধানে চলাফেরা এবং কার সাথে মিশছে সে বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আহসানুল জব্বার বলেন, মাদকের রুট ও ব্যাপকতা ঠেকাতে সীমান্তবর্তী এলাকা ছাড়াও সারাদেশে নজরদারি রয়েছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। অভিযান পরিচালনা করে, মাদক ও মাদক ব্যবসায়ী জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে মাদকে জড়িয়ে পড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যাই বেশি। ইয়াবা আসক্ত হয়ে যারা বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্র গুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে, সেসব বিষযয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। নিরাময় কেন্দ্র গুলোর প্রতিও মনিটরিং জোরদার রয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা যতই কৌশল পাল্টাক না কেন বিভিন্ন অভিযান এ আমরা তাদের গ্রেফতার করছি এবং মাদক উদ্ধার করছি।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু গ্রেফতার বা বল প্রয়োগ করে নয়, মাদকাসক্তি প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-