দুই দফা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর দুই দেশ আর প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়নি। যদিও দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর ঢাকঢোল পিটিয়ে চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু রাখাইনের পরিবেশের এমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যা রোহিঙ্গাদের আদি নিবাসে ফিরতে উৎসাহিত করে। আবার মিয়ানমারও প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসন শুরু হলে পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে গেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেল মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যে শিগিগরই হবে না, আবার সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমন এক অবস্থায় বাংলাদেশের অপেক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নড়বড়ে বলে চীনের কাছ থেকে নতুন কিছু পাইনি। তারা আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে। ফলে ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় সময় লাগবে। আর দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরাসরি ঢাকায় মিয়ানমারের দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছি। এখন সমস্যা হল দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় যে সব কমিটি এবং কমিটিতে যাঁরা ছিলেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তাতে কিছু পরিবর্তন আসবে। তাই বাংলাদেশ চাইলেই আর আগের প্রক্রিয়ায় আলোচনায় বসা যাবে না। তবে বাংলাদেশ যেকোনো মুহূর্তে আলোচনায় বসতে রাজি আছে। তবে বাংলাদেশ একা চাইলেই তো আলোচনা শুরু করা যাবে না, মিয়ানমারকেও বসতে হবে।’
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চার দিনের কক্সবাজার,ভাসানচ ও ঢাকা সফর শেষে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মূল দায়দায়িত্ব মিয়ানমারের এবং সমাধানও এখানেই রয়েছে।’
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির (সেনা অভ্যুত্থান) ফলে দ্রুত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে আরও জটিল হয়ে ওঠায় জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের সুরক্ষা বিষয়ক সহকারী হাই কমিশনার জিলিয়ান ট্রিগস ও কার্যক্রম বিষয়ক সহকারী হাই কমিশনার রাউফ মাজু বুধবার তাদের সফর শেষ করেন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সংহতির আহ্বান জানান।
ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি চালু হওয়া ২০২১ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিশাল দায়িত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
এই সঙ্কটকে অবশ্যই ভুলে যাওয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করেছে ইউএনএইচসিআর।
ট্রিগস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শরণার্থী চুক্তির দিকনির্দেশক নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ মানবতা ও সংহতি দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়া, শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করার জন্য অবশ্যই বাস্তব কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ইউএনএইচসিআরের এই দুই কর্মকর্তা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের মানবিক চেতনা ও উদার আতিথেয়তার জন্য আন্তরিক প্রশংসা করেন।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে আসা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে পালিয়ে আসে। এ সময় সে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সাড়ে ৩ লাখ মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে কক্সবাজার, রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। তবে আন্তজার্তিকভাবে কোনো সাহায্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল না। তাই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ২ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত দেয়।
এ সময় দেড় লাখ মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যায়। এরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এরপর ১৯৯২ সালে আবারও নির্যাতনের মুখে আড়াই লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
এরা বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় ১৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। এ ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগ বন বিভাগের জমিতে স্থাপন করা হয়েছিল। পরে ২০১২ সালের জুনে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা মংডু থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এতে প্রাণ বাঁচাতে পালায় রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।
মিয়ানমার এ হামলায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে দাবি করেন। পরদিন হঠাৎ সেনারা সন্ত্রাসী দমনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসেন। এ সময় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
সর্বশেষ গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। সে দেশে সেনারা সহিংসতার মুখে অপরাধী দমনের নামে শুরু হয় অভিযান। এতে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের তিন বছর আগে আশ্রয় দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ৷ আন্তর্জাতিক সমাজের কাছ বাংদেশের এই মানবিকতা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে৷
ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে যে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, সেটা বাংলাদেশিদের জন্য, বিশেষ করে কক্সবাজারবাসীদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার৷
আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের এই উদারতার ভূয়সী প্রশংসা হলেও যে দেশের কারণে এই সংকটের সৃষ্টি, সেই মিয়ানমারের উপর গত সাড়ে তিন বছরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তেমন একটা চাপ সৃষ্টি হয়নি৷
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-