ভয়ংকর মাদক এলএসডি

বকুল আহমেদ, সমকাল •

ফেনসিডিল, হেরোইন, আফিম, গাঁজা, ইনজেকটিক মাদক, ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস ও খাতের পর এখন দেশে মিলছে ভয়ংকর মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি।

কারবারিরা কত বছর আগে ভয়ংকর এ মাদক দেশে আনা শুরু করেছে, সে তথ্য এখনও নেই সংশ্নিষ্ট কোনো দপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। মাদকটি দেশে কী পরিমাণ বাজার সৃষ্টি করেছে, সে তথ্যও অজানা। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় প্রথম এলএসডি ধরা পড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) হাতে। পরে দৃশ্যমান কোনো অভিযান দেখা যায়নি। কারবারিরা নিজেদের কৌশলেই বড় করছিল এলএসডির বাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর বিষয়টি সামনে এসেছে। টনক নড়েছে সংশ্নিষ্টদের।

বিশেষজ্ঞরা এলএসডিকে দানবের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন, এই মাদক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে এটি। পাশাপাশি সেবনকারী ব্যক্তি অপরকে খুন এবং আত্মহননও করতে পারে।

এলএসডি একটি দামি মাদক। এর বিক্রি ইয়াবা, গাঁজা কিংবা অন্য মাদকের মতো প্রকাশ্যে নয়। বেচাকেনা হয় অত্যন্ত গোপনে ‘ক্লোজ গ্রুপ’-এর মাধ্যমে। দামি মাদক হওয়ায় এর গ্রাহক সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া সন্তানরা। গত ২৬ মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে এলএসডিসহ যে তিনজন ধরা পড়েন সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া। তারা হলেন- সাদমান সাকিব ওরফে রূপল, আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তূর্য এবং আদিব আশরাফ। ছাত্র হিসেবে মেধাবী তারা। তিনজনই রয়েছেন ডিবির রিমান্ডে।

গত শনিবার রাত থেকে রোববার পর্যন্ত খিলগাঁও থানা পুলিশ এলএসডি বেচাকেনা ও সেবনে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে দুই হাজার মাইক্রোগ্রাম এলএসডি, আইস ও গাঁজা পাওয়া যায়। সোমবার তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তারাও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা হলেন- সাইফুল ইসলাম সাইফ, নাজমুস সাকিব, এসএম মনওয়ার আকিব, বিএম সিরাজুস সালেকীন ও নাজমুল ইসলাম। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগ বলছে, ঢাকায় এলএসডি বিক্রি করে এমন আরও ১৫টি গ্রুপ রয়েছে।

অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, সাধারণত ঘটনা ঘটার পর সংশ্নিষ্ট সবাই তৎপর হয়। ঘটনার আগে থেকে সতর্ক থাকার নীতি এ দেশে এখনও বিকশিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ঘটনার তদন্তে নেমে এলএসডির তথ্য মিলেছে। এ ঘটনা ঘটেছে বলেই এখন এলএসডি সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রতিটি জায়গায় সতর্ক থাকার বিষয়টি অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, এই সময়টা বাংলাদেশে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। কারণ এখন দেশের আধুনিকায়ন হচ্ছে। এতে অস্থিরতা বেড়েছে সব জায়গায়। আগে ছিল ফেনসিডিল; এলো ইয়াবা, এলো হেরোইন। দিনে দিনে নতুন মাদক জায়গা করে নিয়েছে এ দেশে। মাদক কীভাবে কোন রুট দিয়ে দেশে আসছে, সে বিষয়ে আগে থেকেই গবেষণা থাকলে প্রতিরোধ করা সহজ হতো।

গত ১৫ মে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগের সামনে থেকে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে। হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতেই মৃত্যু হয় তার। পরিচয় না পাওয়ায় লাশ রাখা হয় মর্গে। পরে পরিচয় মেলে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ডাবের দোকান থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় কোপ দেন হাফিজুর। তার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় ডিবির রমনা বিভাগ রহস্য উদ্ঘাটনে অনুসন্ধানে নামে। তদন্তে জানা যায়, হাফিজুর এলএসডি সেবন করতেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, এলএসডি মানুষকে দানব করে তোলে। মানুষের মস্তিস্কে রাসায়নিক পদার্থ বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে হ্যালুসিনেশন হয় ভয়াবহভাবে।

তিনি বলেন, এলএসডি মানুষের শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুসকে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। দেহের তাপমাত্রাও বাড়ে। সেবনকারী বহুতল ভবনের ছাদে থাকলে সে ছাদ আর নিচের মাটি সমান দেখবে। মাটি দেখে হাঁটতে গিয়ে নিচে পড়ে প্রাণ হারাতে পারে। কভিড মোকাবিলায় সরকার যেমন কঠোর হয়েছে, তেমনি মাদকের ব্যপারেও কঠোর হওয়া দরকার।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, এলএসডির বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। নতুন ভয়ংকর এই মাদক যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে, সে জন্য ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।

এলএসডি সংক্রান্ত দুটি মামলার একটির তদন্ত করছে ডিবি, অপরটি খিলগাঁও থানা পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট ও ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, মূলত বাংলাদেশে এলএসডি আসছে নেদারল্যান্ডস ও কানাডা থেকে। এটি এক ধরনের সিনথেটিক মাদক। অর্থাৎ রাসায়নিক মিশ্রণে মানুষই এই মাদক তৈরি করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, এলএসডি এতটাই শক্তিশালী ও ভয়ংকর যে, সেবনকারীর নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি ব্যবহার করলে অনুভূতি ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সে ধারণা পরিবর্তন করে। এমন দৃশ্য দেখে, যা বাস্তবে নেই। কাল্পনিক জগতে বাস করে। বাস্তবতা বিন্দুমাত্র কাজ করে না সেবনকারীর মধ্যে। সঠিক পথ মনে করে বিপথে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এই মাদক ব্যবহার করলে ভয়ংকর কাজ করতেও পিছপা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অন্যকেও খুন করতে পারে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। বিশ্বের সব দেশেই এলএসডি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এলএসডিকে মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৮ সালের আইনেও তা বলবৎ আছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগ ঢাকায় দুই তরুণের কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। এর পর এলএসডি উদ্ধার-সংক্রান্ত আর কোনো দৃশ্যমান অভিযান দেখা যায়নি অধিদপ্তরটির।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, ২০১৯ সালে এলএসডি উদ্ধারের পর মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয় এ মাদকটির বিষয়ে। নজরদারিও বাড়ানো হয়। এলএসডি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার বিষয়টি অব্যাহত আছে।

আরও খবর