পূর্বকোণ •
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীন দুটি আইডি ব্যবহার করেই ৩ হাজার ৮১৮ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ভোটার করেছেন।
যেখানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ছাড়াও দেশের ১০ জেলায় রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও জয়নাল সিন্ডিকেট অন্য একটি আইডি ব্যবহার করে আরও ৬১ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হয়। এতে তিন আইডি ব্যবহার করে মোট ৩ হাজার ৮৭৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দালাল, অফিস কর্মচারী ছাড়াও নিজের স্ত্রী ও স্বজনদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার করেছেন জয়নাল। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
দুদক অনুসন্ধান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকা নির্বাচন অফিসে কর্মরত আইটি এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে’র কাছে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারের আদলে নিজস্ব সার্ভার রয়েছে। যা নির্বাচন কমিশনের সার্ভারের সাথে সংযুক্তি ছিল। এতে দেশের যে কোনো স্থানে বসেই এই সার্ভারের মাধ্যমে যে কোন উপজেলার ডাটা সহজেই আপলোড করা যেত। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় সার্ভারের পাসওয়ার্ডও সত্য সুন্দরের জানা ছিল। এতে সোনায় সোহাগা ছিল সত্য সুন্দরের। টাকার বিনিময়ে যে কোনো নাগরিককে ভোটার করা ছিল তার হাতের মুঠোয়। জয়নাল আবেদীন টাকার বিনিময়ে সত্য সুন্দর দে ও বিভিন্ন উপজেলার অপারেটরদের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতেন। সেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ঘরে বসে নিমিষেই দেশের যে কোন নির্বাচন কার্যালয়ের নামে ভোটার অন্তর্ভুক্ত করতেন। এভাবে শত শত রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার করেছেন জয়নাল।
দুদক সূত্র জানায়, জয়নাল আবেদীন নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া একটি ল্যাপটপ সংগ্রহ করে। যে ল্যাপটপ শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের কাজে ব্যবহৃত করা হয়। এসব ল্যাপটপের আইডি থেকে নির্বাচন কমিশনের যে কোন কাজ করা যায়। একটি ল্যাপটপের মাধ্যমেই ০৩৫১-০০০০ এবং ৯৩১৮-০০০০ নম্বরের দুইটি আইডি ব্যবহার করতেন জয়নাল। মূলত ল্যাপটপ আইডি পরিবর্তন করা যায় বিধায় ভিন্ন দুটি আইডি ব্যবহার করতেন জয়নাল।
এই দুই আইডি থেকে ৩ হাজার ৮১৮ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছেন তিনি। এরমধ্যে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের ঠিকানায় ১ হাজার ৯৩৭ জন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ঠিকানায় ১ হাজার ১৮ জন, বান্দরবানে ২৬২ জন, নোয়াখালী জেলায় ৩৫ জন, কুমিল্লা জেলায় ২৫ জন, ফেনী জেলায় ২৪ জন, রাঙামাটি জেলায় ৮ জন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৪ জন, খাগড়াছড়ি জেলায় ৩ জন এবং ঝিনাইদহ জেলায় ২ জনকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন জয়নাল। ঘরে বসে সারাদেশে ভোটার করতেন তিনি।
অনুসন্ধানের জানা যায়, জয়নালের ঘরে থাকতো ভোটার হালনাগাদের কাজ করা অপারেটর বয়ান উদ্দিন। যিনি নগরীর কাজীর দেউরি ভিআইপি টাওয়ারে অবস্থিত আল ওয়াফা নামক ট্রাভেল এজেন্সিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গিয়ে ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতেন। এ কাজে সহযোগিতা করতেন দালাল নুরুল আফছার। এছাড়া এ সিন্ডিকেটে পটিয়া ও সাতকানিয়া এলাকায় কাজ করতেন জনপ্রিয় বড়–য়া। রোহিঙ্গা নাগরিকদের চট্টগ্রাম শহরে আসায় বাধা-বিঘœ বা সমস্যার মুখোমুখি হতো, তাদেরকে সাতকানিয়া ও পটিয়ায় বাসা-বাড়িতে রেখে ডাটা সংগ্রহ করা হতো। এসব ডাটা নিয়ে আসা হতো জয়নালের কাছে। আর জয়নাল নিমিষেই তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন।
অন্যদিকে, স্ব-শরীরে কক্সবাজার গিয়ে বিভিন্ন হোটেলের রুমে বসে দালালদের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত রোহিঙ্গাদের ভোটারের তথ্য, ছবি ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করতেন স্বয়ং জয়নালের স্ত্রী আনিছুর নাহার বেগম। তিনিও এ কাজে সরাসরি সিন্ডিকেটের একজন হিসেবে কাজ করতেন। এছাড়া উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাঙ্গুনীয়া, রাউজান ও ফটিকছড়ির সকল রোহিঙ্গা ভোটারদের এন্ট্রি দেয়া হতো হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সাইফুদ্দিনের মাধ্যমে। যিনি ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অসাধু উপায়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধান প্রায় শেষ। এ কাজে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-