ঘূর্ণিঝড় ইয়াস জলোচ্ছ্বাসে সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় ৯ জেলা : বাদ পড়ল কক্সবাজার

বণিক বার্তা •

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বুধবার ভারতের ওড়িশা উপকূল অতিক্রম করার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটির তাণ্ডবে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কক্সবাজারের উপকূলীয় উপজেলাসহ দেশের নিম্নাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

সরকারী হিসাবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের উপকূলীয় নয় জেলার ২৭ উপজেলার মানুষ। এগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেল।

কিন্তু কাকতালীয়ভাবে বাদ পড়েছে কক্সবাজার জেলা।

জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র প্রভাবে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙে জনপদে পানি প্রবেশ করে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বুধবার সকাল থেকে পূর্ণিমার জোয়াড় ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে দুই থেকে আড়াই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজার পৌর এলাকার সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া,মহেশখালীর মাতারবাড়ি, টেকনাফের সেন্টমার্টিন,সদর ইউনিয়নের পেকখালী,উখিয়ার ইনানী,পেকুয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা।

কক্সবাজার পৌর এলাকার সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী উপজেলার বেশ কিছু জায়গায় বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে। একই ভাবে কক্সবাজার পৌর এলাকার সৈকত সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কুতুবদিয়া উপকূলীয় এলাকায় ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত এবং একজনের হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের ২৮টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে এবং হুমকিতে রয়েছে স্কুলভবন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সরকারীভাবে কক্সবাজার জেলার নাম বাদ পড়ায় হতাশ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন বলেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে। দ্রুত আরেকটা সভা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন করা হবে। মাঠের কাজ শেষ হলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সেটা করব।

বুধবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সার্বিক ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উপকূলীয় ১৪টি জেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া আছে। এছাড়া আজ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় নয়টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দিতে ১৬ হাজার ৫০০ শুকনো ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপকূলীয় জেলা, উপজেলাগুলোয় ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য আদান-প্রদানে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এনডিআরসিসি (জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র) ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদানে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে।

জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার-ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। ঝড় আঘাত হানলে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত ছিল। মানবিক সহায়তার যথেষ্ট সংস্থান আগে থেকেই করা ছিল। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট মাস্ক ও স্বাস্থ্য উপকরণ নিশ্চিত করা হয়েছিল। সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো ের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম: জোয়ারের পানি বাড়ছে। বর্তমানে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার মোট ৮৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর চত্বরে জোয়ারের পানি ঢুকে কনটেইনারের নিচের একাংশ পানিতে ডুবেছে। চত্বরের অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে কনটেইনারে বাতাসরোধী ব্যবস্থা থাকায় পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হয়নি বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত বছরের আগস্টেও ভারি বর্ষণ ও পূর্ণিমার জোয়ারে বন্দর চত্বরে পানি উঠেছিল।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বেলা ১টার আগে কর্ণফুলী নদীবন্দর অংশে জোয়ার ৫ দশমিক ৭ মিটার উচ্চতায় ওঠে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানির উচ্চতা বেড়ে মহেশখালের পাশের চত্বরে, নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরের একাংশে পানি ওঠে। তবে পরে ভাটার সময় পানি নেমে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরের পর্ষদ সদস্য জাফর আলম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব ও একই সময়ে মূলত পূর্ণিমার জোয়ার থাকায় বন্দর চত্বরের মহেশখাল এলাকার অংশে পানি ঢুকেছে। পরে ভাটার সময় নেমে গেছে। অন্যান্য সময়ে পূর্ণিমার জোয়ারে পানির উচ্চতা বাড়লেও বন্দর চত্বরে ওঠে না। ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীর পানির যে উচ্চতায় থাকে, সেখান থেকে সাড়ে সাত মিটার উঁচু বন্দরের জেটি। বাতাসরোধী ব্যবস্থা থাকায় পানি কনটেইনারে ঢুকে পণ্য নষ্ট হয়নি।’

ভোলা: জেলার ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দু-তিন ফুট ওপরে উঠলেও তা নেমে গেছে। দুর্গম চরে প্রায় ২৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে ৯০০ গরু-মহিষ ভেসে গেছে। জেলাটিতে ৬৯১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, যাতে আশ্রয় নিয়েছিল দুই হাজার মানুষ। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এসব মানুষ এরই মধ্যে ঘরে ফিরে গেছে।

পটুয়াখালী: জোয়ারের পানি বাড়লেও তা বিপত্সীমার নিচেই অবস্থান করছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ১৭২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। গতকাল সকালে তারা ফিরে গেছে। এসব মানুষ জোয়ারের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আসে ও ভাটার সময় নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়েছে পটুয়াখালীতে।

সাতক্ষীরা: জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-ছয় ফুট উচ্চতায় রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। জেলায় ১ হাজার ২৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ২৮০ জন আশ্রয় নিয়েছিল, যারা পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যায়।

বরগুনা: জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দু-তিন ফুট বেড়ে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের বেশকিছু জায়গা ভেঙে গেছে। ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৫২০ জন আশ্রয় নিয়েছিল।

ঝালকাঠি: জেলায় ৪৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। এগুলোতে আশ্রয় নেয় ৪৯৭ জন মানুষ। জোয়ারের পানির উচ্চতা এখনো বিপত্সীমার ওপরে রয়েছে। তবে জেলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

পিরোজপুর: মঠবাড়িয়া উপজেলার মাঝের চর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ১০-১২টি মাছের ঘের ও কয়েক একর সবজি বাগান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মাঝের চর আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫০ জন আশ্রয় নিয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে তিন ফুট ওপরে উঠেছে। ২৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।

বরিশাল: ১ হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। তবে কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে আসেনি। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি। কোনো ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।

বাগেরহাট: জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার ২০-২১টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এতে ২ হাজার ৭০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা হিসেবে শুকনো খাবার (চিড়া, গুড় ও খাওয়ার স্যালাইন) সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছে।

চাঁদপুর: আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য উপজেলাওয়ারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানির উচ্চতা স্বাভাবিক। সামান্য ঝড়ো হাওয়া বইছে।

লক্ষ্মীপুর: জেলার রামগতি, কমলগঞ্জ উপজেলার নিচু এলাকায় সামান্য জোয়ারের পানি উঠেছে। কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ আসেনি।

খুলনা: জেলায় মোট ১ হাজার ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হলেও কেউ আসেনি। জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিক আছে।

ফেনী: জেলায় মঙ্গলবার মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে একজন মারা গেছে। জেলার ৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, তবে এগুলোতে কাউকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়নি।

নোয়াখালী: জেলায় মোট ৩৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। ৩০০ জন আশ্রয় নিয়েছিল। স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি চার ফুট ওপরে উঠেছিল। জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে।

আরও খবর