রমজানের প্রস্তুতি : মুমিনের পথ ও পাথেয়

আবুল কাসেম আশরাফ •


রমজান অন্য সব সাধারণ মাসের মতোই একটি মাসের নাম। কিন্তু ফজিলত, বরকত ও রহমতের কারণে এর রয়েছে অনন্য মর্যাদা।এমন মহিমান্বিত ও ফজিলতের মহান মাস আমাদের সামনে উপস্থিত। এ পবিত্রময় মাসটি সৌভাগ্য ও আখিরাতের অবর্ণনীয় অফার নিয়ে আমাদের মাঝে আগমন করে। যে মাস হলো কুরআন অবতরণের, তাকওয়া অর্জনের ও রহমত বর্ষণের।

রমজান মাস কীভাবে কাটাব, তার জন্য বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকে। কেউ পুরো রমজান নফল ইবাদতেই কাটিয়ে দেন,কেউ কুরআনের প্রতি অধিক জোর দেন, কেউ সাদাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন।

প্রত্যেকেই তার সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, সুন্দর একটি রমজান কাটানোর। সুন্দর একটি রমজান কাটানোর জন্য আমরা বাছাই করে কিছু আমল ও ইবাদাতের লিস্ট তৈরি করেছি। এতে আমাদের জন্য রমজানের ফজিলত ও বরকত ভালোভাবে অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

০১. প্রতিদিন ন্যূনতম দুই ঘণ্টা কুরআন তিলাওয়াত করা। এটা এক বৈঠকে একসাথেও হতে পারে, কিংবা আলাদা আলাদা বৈঠকে ভিন্ন ভিন্ন সময়েও হতে পারে। কুরআন তিলাওয়াত অবশ্যই সুন্দরভাবে তাজবিদের সহিত পড়া উচিত, তাড়াহুড়ো কখনো কাম্য নয়।

০২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সহিত আদায়ে গুরুত্বারোপ করা।পাশাপাশি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পূর্বে ও পরের সুন্নাত গুলো আদায়ের প্রতি বিশেষ ইহতিমাম করা।

০৩. তারাবিহর সালাত হলো সুন্নাতে মুআক্কাদা আইন। আর জামাআতে পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। তারাবিহের সালাত নিয়মিত ত্রিশদিনই মসজিদে গিয়ে জামাআতের সহিত আদায় করা।

০৪. সম্ভব হলে রমজানে কিয়ামুল লাইল, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত, দ্বীনি কিতাব অধ্যয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে পুরো রাত্রি জাগ্রত থাকা। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া এবং এটাকে ধীরে ধীরে এমন অভ্যাসে পরিণত করা উচিত। যাতে সারা বছরই তা নিয়মিত পড়ার তাওফিক হয়।

০৫. কম ঘুমানোর চেষ্টা করা। কারণ,এটা দুনিয়ার জীবনে মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় অফারের মাস। আমরা দুনিয়ার জীবনে সাধারণত কোনো বড় অফার পেলে তা অর্জনের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি।শত কষ্ট হলেও সেটা পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। অথচ রমজান হলো মুমিনের জীবনে আখিরাতের সবচেয়ে বড় অফারের মাস। তাই যথাসম্ভব ঘুম কমিয়ে সময় সেভ করে যত সাওয়াব ও ফজিলত অর্জন করে নেওয়া যায়, ততই লাভ।

০৬. প্রতিদিন ন্যূনতম একজনকে ইফতার খাওয়ানোর চেষ্টা করা; সামান্য পানি বা খাবার দিয়ে হলেও। বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনেও খাওয়ানো যায়, প্যাকেটে বা পাত্রে করে বাসায়ও পাঠিয়ে দেওয়া যায়। অসহায়, গরিব, মুসাফির, আলিম, আত্মীয়স্বজন ও পড়শীদের মধ্য থেকে যে কাউকেই বেছে নেওয়া যেতে পারে। তবে মুত্তাকি ও দ্বীনদারদের প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করা।

০৭. এ মাসে সবর বা ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করা। অযাচিতভাবে কাউকে গালিগালাজ বা কারও সমালোচনা না করা। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা। সবার প্রতি, বিশেষত নিজের অধীনস্ত চাকর-বাকর, সন্তান-সন্তুতিসহ সব ধরনের লোকদের প্রতি সদয় হওয়া।

০৮. সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। যারা শিরক-বিদআতে লিপ্ত, তারা সঠিক বিষয়টি জেনে এসব থেকে সারাজীবনের জন্য তাওবা করে নেবে। যারা কবিরা গুনাহে অভ্যস্ত,তারা চিরজীবনের জন্য কবিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে। আর যারা সগিরা গুনাহে অভ্যস্ত, তারা আজীবনের জন্য সগিরা গুনাহ ছেড়ে দেবে।

০৯. রমজানের শেষ দশকে নিজ এলাকার মসজিদে ইতিকাফে বসা। ইতিকাফে বসার জন্য কারও থেকে কোনো ধরনের বিনিময় গ্রহণ না করা।

১০. রমজানে দান-সদকা বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। তাতব্য-তালাশ করে গরিব আলিমদের প্রতি অধিক খেয়াল রাখা; বিশেষত যারা কারও কাছে হাত পাতে না,কারও কাছে সাহায্য চাইতে লজ্জাবোধ করে।

১১. সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে কার্পণ্যতার পরিচয় না দেওয়া। সামর্থ্য থাকলে অধিক দামি নিসাবের ফিতরা আদায় করার চেষ্টা করা। আধা সা গম তো সর্বনিম্ন মূল্যের ফিতরা। ধনী বা সামর্থ্যবান হলে আধা সা গমের পরিবর্তে এক সা খেজুর, কিসমিস বা পনিরের দামে ফিতরা আদায় করার চেষ্টা করা।

১২. রমজানে জাকাতের টাকা আদায় করলে বেশি ভালো। নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকলে এ মাসেই জাকাত হিসাব করে আদায় করা যেতে পারে। বছর শেষ হওয়ার আগেও জাকাত দেওয়া যায়। তাই নিসাব পরিমাণ সম্পদের উপর এক চান্দ্র বছর অতিক্রান্ত না হলেও রমজান মাসে অগ্রীম বছরের জাকাত দিয়ে দিলে লাভ বেশি। এতে সাওয়াব অনেকগুণে বেশি হয়। জাকাত ভালোভাবে বুঝেশুনে উপযুক্ত খাতে ব্যয় করা জরুরি। নিজের মনমতো যেকোনো জায়গায় চোখ বন্ধ করে জাকাত দেওয়া উচিত নয়।

১৩. অনলাইন ও গুনাহের উপকরণগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। অনলাইন মাধ্যম একান্ত দ্বীনি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও সময় নির্দিষ্ট করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা। সবসময় এতে এক্টিভ থাকলে এবং অন্যান্য সময়ের মতোই এতে সময় ব্যয় করলে ইবাদতের মজা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।

১৪. কোনো গুনাহের অভ্যাস থাকলে এ মাসেই তা থেকে স্থায়ীভাবে তাওবা করে নেওয়া। আজীবনের জন্য এসব ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করা। যেমন : মুভি-নাটক দেখা, পর্নো দেখা, গেম-খেলায় আসক্ত থাকা, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা করা, অনলাইনের নানা ফিতনায় আক্রান্ত হওয়া, কুদৃষ্টির অভ্যাস থাকা ইত্যাদি। কেননা, এ মাসে শয়তান বন্দী থাকে। তাই খুব শক্তভাবে সুদৃঢ় নিয়ত করে গুনাহ ছেড়ে লাগাতার একমাস আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলে আশা করা যায়, আল্লাহ তা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দেবেন।

১৫. শবে কদর পাওয়ার উদ্দেশ্য রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতই পুরোপুরি গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা; বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে। শুধু সাতাশ তারিখের অপেক্ষায় থেকে অন্যান্য রাতে গাফলতি না করা।

১৬. রমজান শেষে বেশিরভাগ মানুষই ইদের কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যায়। সেসময় দুটি জিনিসের বড় অভাব পরিলক্ষিত হয়। এক : দৃষ্টির হিফাজত। দুই : ব্যাপক অপচয়। নারীদের ভীড়ে খুব কম মানুষই দৃষ্টির হিফাজত করতে পারে। আর অপচয়, সে তো এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোটকথা, রমজানটা সবার ভালো কাটুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সুন্দর একটি রমজান কাটানো সত্যিই বড় সৌভাগ্যের বিষয়! আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজান মাসের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রেখে আখিরাতের চিরস্থায়ী আ্যকাউন্ট ভারী ও সমৃদ্ধ করার তাওফিক দান করুন।


সহকারী শিক্ষক

খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। খরুলিয়া, সদর, কক্সবাজার।