জানাজায় মানুষ বেশি হলে মৃতব্যক্তির কী লাভ

প্রায়ই দেখা যায় কারো জানাজায় লাখো মুসল্লির ঢল। আবার অনেক কারণে অনেকের জানাজায় মুসল্লির সংখ্যা থাকে হাতেগোনা। পরিস্থিতির কারণেই জানাজায় মানুষ কম এবং বেশি হয়। তবে এই নিয়ে আছে নানান যুক্তিতর্ক। অনেকে আছেন না জেনেই এই বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। যা একেবারেই অনুচিত।

অনেকের মনেই প্রশ্ন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ার কী কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে? জানাজায় বেশি মানুষ উপস্থিত হওয়া ইসলামি শরিয়ত কোন দৃষ্টিতে দেখে? এতে মৃতব্যক্তি কি উপকারিতা পাবেন? হ্যাঁ, জানাজায় বেশি মানুষ উপস্থিত হওয়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ এবং কাম্য। কেননা জানাজায় বেশি মানুষ উপস্থিত হলে মৃতব্যক্তির জন্য যেমন কল্যাণের তেমনি যারা জানাজায় উপস্থিত হবে তাদের জন্যও কল্যাণের। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা প্রমাণিত-

মৃতব্যক্তির কল্যাণ ও উপকার
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,‘কোনো মৃতব্যক্তির ওপর যখন একদল মুসলিম; যাদের (সংখ্যা) একশ’ হবে, জানাজার নামাজ আদায় করে এবং সবাই তার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে, তবে তার জন্য এ সুপারিশ অবশ্যই কবুল করা হবে।’ (মুসলিম)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘কুদায়দ’ অথবা ‘উসকান’ নামক স্থানে তার এক ছেলে সন্তান মারা যায়। তিনি আমাকে বললেন, হে কুরায়ব! দেখ কিছু লোক একত্রিত হয়েছে কিনা? আমি বের হয়ে দেখলাম কিছু লোক একত্রিত হয়েছে। আমি তাকে খবর দিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- বল, তাদের সংখ্যা কি চল্লিশ হবে?

(আমি) বললাম, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, তাহলে লাশ বের করে নাও। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি- ‘কোনো মুসলিম মারা গেলে, তার জানাজায় যদি এমন চল্লিশজন দাঁড়িয়ে যায় যারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না তবে মহান আল্লাহ তার (মৃতব্যক্তির) অনুকূলে তাদের প্রার্থনা কবূল করেন।’ (মুসলিম)

জীবিতদের কল্যাণ
মৃতব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত হওয়া জীবিত মুসলমানের জন্য ফরজে কেফায়া এবং সওয়াবের কাজ। হাদিসে একাধিক বর্ণনায় এসেছে- হজরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) র কাছে বসা ছিলেন। এমন সময় হজরত খাব্বাব (রা.) এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন- ‘হে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর! আপনি কি আবু হুরায়রা (রা.) র কথা শুনছেন না?

তিনি বললেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছেন-‘যে ব্যক্তি জানাজার সঙ্গে ঘর থেকে বের হয় এবং জানাজার নামাজ আদায় করে, অতঃপর দাফন করা পর্যন্ত জানাজার সঙ্গে থাকে, তাকে দুই ক্বিরাত সাওয়াব দান করা হবে। প্রতিটি ক্বিরাত হবে উহুদ পাহাড় সমতুল্য। হজরত ইবনে ওমর (রা.) এ কথা যাচাই করার জন্য হজরত খাব্বাবকে হজরত আয়েশা (রা.) র কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

হজরত খাব্বাব (রা.) চলে গেলে ইবনে ওমর (রা.) মাসজিদের কাঁকর থেকে এক মুষ্টি কাঁকর হাতে নিলেন এবং খাব্বাব ফিরে না আসা পর্যন্ত তা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করছিলেন।

হজরত খাব্বাব ফিরে এসে বললেন, ‘হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ঠিকই বলেছেন। (তখন) হজরত ইবনু ওমর (রা.) তাঁর (হাতে থাকা) কাকর জমিনের উপর ছুঁড়ে মেরে বললেন- ‘আমরা অবশ্যই বহু সংখ্যক ক্বিরাত বরবাদ করে দিয়েছি।’ (মুসলিম)

– হজরত সাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জানাজার নামাজ আদায় করে তাকে এক ক্বিরাত সাওয়াব দেয়া হবে। আর সে যদি দাফন কাজে শরিক থাকে তবে ওই ব্যক্তি দুই ক্বিরাত পাবে। এক ক্বিরাত হলো উহুদ পাহাড় সমতুল্য।’ (মুসলিম)

মৃতব্যক্তির সংবাদ প্রচারের গুরুত্ব
হজরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) আসরের পর ইন্তেকাল করলে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কে তার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো- তার জানাজা কি এখন পড়া যেতে পারে?

তিনি (হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আশপাশের গ্রামসমূহে খবর না দিয়ে রাফের মতো ব্যক্তির জানাজা পড়া যায় না।’ (বায়হাকি) এ বর্ণনার আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেন, জানাজার নামাজে অংশগ্রহণের জন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের মৃত্যু সংবাদ দেয়া মোস্তাহাব। তবে জানাজা ছাড়া যদি মৃত ব্যক্তির গুণাগুণ বর্ণনার উদ্দেশ্যে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার ও লোকজন জমায়েত করা হয় তবে তাতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। হাদিসে এসেছে-

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও হুজায়ফা (রা.) প্রমুখ সাহাবারা নিজেদের মৃত্যু সংবাদ এভাবে প্রচারিত হওয়ার ভয়ে (তাদের) মৃত্যু সংবাদ কাউকে জানানোর ব্যাপারে আগেই নিষেধ করে গেছেন।’ (তিরমিজি) তবে কারো মৃত্যু হলে তার সংবাদ মানুষকে জানানো উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকেও তা প্রমাণিত। হাদিসে এসেছে-

– হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন,রাসূলুল্লাহ (সা.) বাদশা নাজ্জাশির ইন্তেকালের দিন তার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে জানাজার স্থানে গেলেন, অতঃপর সাহাবায়ে কেরামকে কাতারবন্দি করে চার তাকবিরের সঙ্গে জানাজা আদায় করলেন।’ (বুখারি)

– হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি রাতে ইন্তেকাল করলে সাহাবারা তাকে রাতেই দাফন করে দেন। সকালে সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জানানো হলে তিনি বলেন, কেন তোমরা আমাকে (তখন) জানালে না?’ (বুখারি)

মনে রাখতে হবে
জানাজায় বেশি মানুষ উপস্থিত হওয়ায় উভয়ের অনেক উপকারিতা আছে। তবে তা যেন জাহেলি যুগের উদ্দেশ্যে না হয়। সাওয়াবের উদ্দেশ্যে জানাজায় অংশগ্রহণ মোস্তাহাব। একাধিক বর্ণনায় এসেছে-

– ইমাম নববি (রাহ.) বলেন-‘ইসলাম আবির্ভাবের আগে জাহেলি যুগের মতো (মৃত্যুর সংবাদ প্রচার) না করে শুধু জানাজার নামাজের সংবাদ দেয়ার জন্য মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা মোস্তাহাব। কেননা হাদিসে জাহেলি যুগের মতো মৃতের গুণগান গেয়ে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করতে নিষেধ করা হয়েছে।’

– হজরত ইবনে হাজার আসকালানি (রাহ.) বলেন, মৃত্যু সংবাদ প্রচার নিষেধ নয়, নিষেধ হল জাহেলি যুগের কর্মকাণ্ড।’

– হজরত ইবরাহিম হালাবি (রাহ.) বলেন, ‘মৃতব্যক্তির গর্ব-গৌরবের উল্লেখ ছাড়া সাধারণভাবে অলিতে-গলিতে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা দোষণীয় নয়। কেননা জাহেলি যুগের প্রচার তো হলো- বিলাপ-আর্তনাদের সঙ্গে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা।’

মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনো মুমিন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা। জানাজায় উপস্থিত হওয়া। আর এতে উভয়ের জন্য রয়েছে কল্যাণ ও সাওয়াব। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জানাজায় শরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। মৃতব্যক্তির জন্য কল্যাণ ও দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আবার নিজেদের দুই ক্বিরাত সাওয়াব অর্জনের তাওফিক দান করুন। জাহেলি রীতি বর্জন করে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আরও খবর