পূর্বকোণ •
ইয়াবা কারবারিদের পদভারে ফের উত্তাল কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরা এখন নির্বাচনী মাঠে। আলোচনার ঝড় তুলেছে ইয়াবা কারবারিদের এমন গণসংযোগ।
তফসিল ঘোষণার খবর পেয়ে টেকনাফের একটি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৭৭ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি তৎপর হয়েছেন। সাধারণ জনগণ জানিয়েছেন, তারা কোনভাবেই চান না ইয়াবা কারবারিরা প্রার্থী হোক, হলেও তারা যেন নির্বাচিত হতে না পারেন। তারা মনে করছেন, ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলেও অনেক সময় পলাতক থাকেন। আবার কারাগারে থাকেন। এতে জনগণ সঠিক সেবা পায় না।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল মনে করেন ইয়াবা কারবারি প্রার্থী বা নির্বাচিত হলে মাদক রোধ অসম্ভব হবে। মাদক কারবারিদের প্রার্থিতা বাতিলের আইন প্রণয়নের দাবি তার। পুলিশ বলছে, কারা-ফেরত মাদক কারবারিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, সাবরাং, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়েছে। ৫টি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ ১১ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৮ মার্চ। মনোনয়নপত্র বাছাই ১৯ মার্চ এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৪ মার্চ। এর বাইরে টেকনাফ পৌরসভা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের তফসিল এখনো ঘোষণা হয়নি।
এদিকে তফসিল ঘোষণা না হলেও টেকনাফ পৌরসভায় এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যার মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুস শুক্কুর। তিনি মেয়র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীও। এই আবদুস শুক্কুর ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাত থেকে ফুল নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ওই সময় মোট ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। ২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুতে আবদুস শুক্কুর জামিনে মুক্তি পান। এরপর থেকে টেকনাফ পৌরসভায় তাকে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাশী ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ করতে দেখা গেছে। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র প্রার্থীসহ ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অন্তত ২০ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রচারণা চালাচ্ছেন যারা চিহ্নিত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। যাদের বেশিভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ও অস্ত্র মামলা।
তফসিল ঘোষিত টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় আছেন ৪ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। যার মধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়াও রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ও অস্ত্র আইনে কয়েকটি মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টার সময় শাহাজান মিয়াকে আটক করা হয়। পুলিশ তাকে টেকনাফ ফিরিয়ে এনে ২৮ জুলাই লেঙ্গুরবিলের বাড়িতে অভিযান চালায়। এসময় ৫০ হাজার ইয়াবা, ৪টি দেশীয় অস্ত্র (এলজি) ও ২৫টি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় কারাগারে পাঠানো হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরেন এ বছরের জানুয়ারির শুরুতে। তখন থেকে নিজে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই শাহাজান মিয়া, তার পিতা ও ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণের সময় তাঁর এক ভাইও ছিলেন।
আত্মসমর্পনকারী দলে আরো ছিলেন টেকনাফের গোদার বিল এলাকার আলী আহমদের পুত্র জিয়াউর রহমান। তিনিও সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী। টেকনাফের ছোট্ট হাবির পাড়ার খলিলুর রহমানের পুত্র হাম জালালও এক ইয়াবা মামলায় কারা-ফেরত। তিনি আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আত্মসমর্পনকারী টেকনাফের এনামুল হক ইউপি সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। টেকনাফ সদর ইউনিয়নে এ রকম আরো ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী পাওয়া গেছে যারা চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নে ইয়াবা কারবারিদের প্রার্থী হিসেবে প্রচারণার তথ্য পাওয়া গেছে। সাবরাং ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৪ জন, বাহারছড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৫ জন, হ্নীলা ইউনিয়নে চেয়ারম্যানে প্রার্থীসহ ১১ জন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৭ জন ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে ৩ জন প্রার্থী রয়েছেন যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি।
টেকনাফের আবদুল খালেক নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, ‘ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলেও কোন সেবা পাওয়া যায় না। বছরের বেশির ভাগ সময় তারা পালিয়ে বেড়ান। আবার অনেকে কারাগারে থাকেন। এদের ভোট দেয়া বা না দেয়া সমান।’ আবুল বশর নামের এক তরুণ বলেন, ‘টেকনাফের ইয়াবার বদনাম দূর করতে হবে। এবার নির্বাচনে ইয়াবা কারবারিদের বয়কট করা হবে।’
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, ‘আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিরা স্বঘোষিত মাদক কারবারি। যারা আদালতের মাধ্যমে জমিন নিয়ে এলাকায় ফিরেছে। সম্প্রতি নির্বাচনে তারা প্রার্থী হিসেবে মাঠে গনসংযোগ শুরু করেছে। এরা যদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসে তাহলে এলাকার পরিস্থিতি কোন্ধসঢ়; পর্যায়ে যাবে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’ এসব বিষয় সরকারের দৃষ্টিতে এনে এদের প্রার্থী হতে না দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
উখিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরী জানান, ‘এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ইয়াবা। ইয়াবা কারবারিরা তাদের ব্যবসার নিরাপত্তার জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। সরকারের উচিত তাদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না দেয়া।’ তাই দ্রুত আইন প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানান, ‘কারা-ফেরত বা তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের উপর কঠোর নজর রাখা হয়েছে। পলাতক মাদক মামলার আসামি গ্রেপ্তারে ধারাবাহিক অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। এখন সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-