সমকাল •
কক্সবাজার শহর থেকে গাড়িতে চড়ে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রাসুলাবাদ গ্রামে পৌঁছতে লাগল প্রায় আড়াই ঘণ্টা। গ্রামটির ক্যাংপাড়ায় পাহাড় ও এর আশপাশে ১৩ একর জায়গাজুড়ে ছিল আদিবাসী রাখাইনদের ৩০০ বছরের পুরোনো দক্ষিণ হ্নীলা বড় বৌদ্ধবিহার।
কিন্তু সেটির প্রবেশমুখেই এখন গরুর খামার- যেটির নাম নাফ এগ্রো ফার্ম। পাশেই কয়েকটি আধাপাকা ঘর।
খামারের ভেতরে হ্নীলা কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড এবং ভবন থাকলেও বাস্তবে চালু নেই সেটি। ভবনটিও ব্যবহার হচ্ছে খামারের কাজে। কিছুদূর এগোলে চোখে পড়ে আরও কিছু স্থাপনা। এসব ঘরের একটিতে এনজিও অফিস আর বাকিগুলো অন্যান্য কাজে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিহারের জমি দখল করে তৈরি হয়েছে ৪০টির বেশি বসতি। অবৈধ বসতি গড়ে ওঠার আগে-পরেও একাধিকবার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বিহারে।
বর্তমানে বন্ধ এই বিহারের যাবতীয় কার্যক্রম। বিহারের মূল অংশ দেখতে চাইলে উঠতে হবে পাহাড়ে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অপরূপ সবুজ অরণ্যের পরতে পরতে এখনও রয়ে গেছে বিহারের নানা ক্ষতচিহ্ন। পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন, আগের স্থাপনা, দুর্গ, মন্দির ও ১৯টি মূর্তি ভেঙে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ধ্বংসাবশেষ বা নানা টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পাহাড়ের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু পিলার। আরেক প্রান্তে একটি মূর্তি এখনও বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। যদিও সেই মূর্তি দখলদাররা একটি টিনের ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সেই ঘরেই দেখা গেল আরও বেশ কয়েকটি ভাঙা মূর্তি।
এভাবে প্রশাসনের চোখের সামনেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে টেকনাফ ও উখিয়ার সবচেয়ে বড় এই বৌদ্ধবিহার। ২০১১ সালে বিহারের কিছু অংশ দখল হওয়ার পর থেকেই বিহার পরিচালনা কমিটি মিছিল, মানববন্ধন, বিবৃতি থেকে শুরু করে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রশাসনের সহায়তা চায়। কিন্তু প্রশাসনের সামনেই দিনে দিনে এ বৌদ্ধবিহার নিশ্চিহ্ন হয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে বিহার পরিচালনার কাজে যুক্ত মানুষদের। ৩৬ ক্ষমতাবানের দখলে এখন পুরো বিহার।
শতবর্ষী একটি বটগাছের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিলেন ৭০ বছর বয়সী মংবুরি। ১৯৫০ সালে এই বৌদ্ধবিহারের পাশেই তার জন্ম। তিনি বলছিলেন, দখলদাররা শুধু বিহার ধ্বংস করেনি; বটগাছটিও কেটে ফেলেছে। অথচ তাদের ধর্মে বটগাছ কাটাকে পাপ মনে করা হয়। সেই ছোট্টবেলা থেকেই মংবুরি এই বিহারে উৎসবে শামিল হতেন। তখন টেকনাফ ও উখিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বছরে একবার এখানে মিলিত হতেন।
আগে রাখাইন ছেলেমেয়েরা বিহারে নিয়মিত লেখাপড়া করত। সেই স্মৃতি মনে করে মংবুরি বলেন, দখলদাররা এখানকার পাহাড় কেটেছে। জঙ্গল এবং আম-কাঁঠালসহ নানা ফলগাছও তাদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি। এখানে শতাধিক মূর্তি ছিল। সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রাচীন সব স্থাপনা এখন ইতিহাস, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যে পিতল ও রুপার মূর্তিগুলো চুরি হয়ে গেছে। মহামতি বুদ্ধের বিগ্রহও ধ্বংস করা হয়েছে। প্রশাসনের সামনে সব সম্পদ বছরের পর বছর ধরে লুট করা হয়েছে। প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হয়নি।
প্রৌঢ় মংবুরি বলেন, এখানকার বৌদ্ধদের ওপর অনেক নির্যাতনও হয়েছে। প্রাণের ভয়ে তারা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে রাখাইনরা এখন বিহার এলাকায় ঢুকতে পারেন না।
রাখাইন নেতাদের অভিযোগ, কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ প্রয়াত মোহাম্মদ আলী ২০০১ সালে তৎকালীন ভিক্ষু উ পঞঞা বংশ মহাথেরোকে ভুল বুঝিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তি করে বিহারের প্রায় ১০ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেন। বিহারের ভূমিতে রোপণ করা বৃক্ষের লাভের অংশ ভাগ করার উদ্দেশ্যে চুক্তিটি করা হয়েছিল। দেবোত্তর সম্পত্তি ইজারা দেওয়া বেআইনি বলে এক বছর পর সেই চুক্তি বাতিল করা হয়। সেটি বাতিলের প্রায় এক দশক পর ২০১১ সালে মোহাম্মদ আলী বিহারের কিছু জমি জোর করে নিজের দখলে নেন। ওই সময় একাধিকবার হামলার ঘটনাও ঘটে।
২০২০ সালে মারা যাওয়ার পর তার বড় ছেলে ২নং হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব মোরশেদ আলী বিহারটি পুরোপুরি দখলে নেন। তার সঙ্গে দখলে যোগ দেন আরও ৩৫ জন প্রভাবশালী। তারা কয়েক দফা হামলা চালিয়ে বৌদ্ধবিহারের দরজা-জানালা, আসবাবপত্র, কাঠের সিঁড়ি ও অবকাঠামো খুলে নিয়ে যান। মন্দিরের ২০টি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তির মধ্যে ১৯টিই চুরি হয়ে যায়। বিহার এলাকার বড় বড় গাছও কেটে ফেলা হয়। এখন সেখানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ঘর।
জমিদার রাপুয়া চৌধুরী এ বৌদ্ধবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রথম পুরোহিত বা ভান্তে ছিলেন উ কাওয়ানা মহাথেরো।
বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যা জ অং বলেন, বর্তমানে বিহারের জমিতে ৪০টির বেশি অবৈধ বসতি রয়েছে। সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরন ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে। তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমিটি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর বড় ছেলে মাহবুব মোরশেদ আলী বলেন, ২০০১ সালে তার বাবার সঙ্গে বিহারের পুরোহিতের একটি চুক্তি হয়। যার শর্ত ছিল, বাবা গাছ লাগাবেন এবং লাভের অংশ সমানভাবে ভাগাভাগি করা হবে। এখন সরকার চাইলে আমরা দখল ছেড়ে দেব। তবে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এ দিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আসা নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীদের একটি প্রতিনিধি দল হ্নীলার বিহারটি পরিদর্শন করে উদ্বেগ প্রকাশ করে। পরদিন তারা কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান ও জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের সঙ্গে বৈঠক করে চার দফা প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- দ্রুত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের কাছে বিহার ভূমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত বিহার পুনঃস্থাপন এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের নির্ভয়ে বিহারে যাতায়াত নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ড. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি বা ইজারা দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। প্রাচীন হ্নীলা বৌদ্ধবিহারটি উদ্ধার করে এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেব।
জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসন দখলদারদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে পুলিশের পক্ষ থেকে বিহারের জমি দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা হবে।
• —-সমকাল
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-