পাহাড়ে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল জকির

আবদুর রহমান, (বাংলা ট্রিবিউন) টেকনাফ •

কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক-মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল সবই চলে। পাহাড়ি এসব শিবিরকে কেন্দ্র করে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল। মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো জকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত। অপরাধের রাজ্যের সর্বশেষ নেতৃত্বে ছিল সে। মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় জকির ডাকাত। ডাকাতি ছাড়াও তারা অপহরণ, ছিনতাই, মাদক কারবারে জড়িত ছিল। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় তার আরও দুই সহযোগী নিহত হয়েছে।

নয়াপাড়ার সি-ব্লকের আমিনের ছেলে জাকির। তার মৃত্যুতে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে বাসিন্দারা। নিহত অপর দুজন হলো, মো. হামিদ ও শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের মো. জহির।

‘জকির মূর্তিমান আতঙ্কের নাম’

জকির ডাকাত গ্রুপ মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম উল্লেখ করে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, জকিরসহ তার সহযোগীদের নামে ধর্ষণ, ডাকাতি, হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। জকিরের বিরুদ্ধে ২০টির বেশি মামলা রয়েছে। মূলত তারা ক্যাম্পে ত্রাস ছিল।

তিনি বলেন, ‘এই গ্রুপকে ধরতে র‌্যাব-১৫ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার বিকালে নয়াপাড়া-মৌচনি রোহিঙ্গা শিবিরের পশ্চিম পাহাড়ে জকির বাহিনীর আস্তানা ঘিরে ফেলে র‍্যাব। মাইকিং করে তাদের বারবার আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা র‌্যাবকে লক্ষ্যে করে গুলি চালায়। র‌্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। ঘণ্টাখানেক গোলাগুলির পর ডাকাতরা পিছু হটে পাহাড়ি অঞ্চলে ঢুকে পরে। পরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি তিন জনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ডাকাত দলের প্রধানও ছিল। এ ঘটনায় র‌্যাবের এক সদস্য গুলিবিদ্ধসহ দু’জন আহত হয়েছেন।’

র‌্যাব বলছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল, দুটি বন্দুক, ৫টি ওয়ান শুটারগান ও ২৫ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

কক্সবাজারের-টেকনাফ প্রধান সড়ক থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে নয়াপাড়া মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝামাঝি পাহাড়ি এলাকায় জকির ডাকাত আস্তানা গড়ে তোলেন। ক্যাম্পের ত্রাস হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত জকির আহমদ ওরফে জকির সেখানে আশ্রয়স্থল বানিয়ে গড়ে তুলেন অপরাধের রাজ্য। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানবপাচার, অপহরণ এমন কোনও অপরাধ নেই তার রাজ্যে হতো না। অপরাধের এত শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে সে, যেখানে সাধারণ লোকজনের চলা ফেরা তো দূরে থাকুক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রবেশ করতে বেগ পায়।

কে এই জকির

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি ব্লকের আমিনের ছেলে জকির (২৮)। জকিরের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় জকির বাহিনী ভিন্ন নামেও পরিচিত। বিশেষ করে টেকনাফের নয়াপাড়া মৌচনি-শালবন, জাদিমুরা, লেদাসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করতেন জকির ডাকাত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করতো নূরে আলম ডাকাত। তার গ্রুপ এক আনসার সদস্যকে হত্যা করে তার অস্ত্র লুট করেছিল। ২০১৮ সালে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সে। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয় সলিম বাহিনী। নূরে আলম ও সলিম দু’জনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল জকিরের। কিন্তু ইয়াবার মুনাফার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সলিমকে হত্যা করে জকির বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পে জকির প্রায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে জাদিমুরা, মৌচনি-শালবন ক্যাম্পের পাহাড়ে অপরাধের ‘রাজা’ বনে যান।

আয়ের উৎস ইয়াবা, মানবপাচার ও চাঁদাবাজি

জকির বাহিনীর অর্থের জোগানের একটি বড় উৎস ইয়াবা ও মানবপাচার। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা ও মানবপাচার করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেয় তারা। এমনকি সাগর পথে মানবপাচারের আগে ওইসব পাহাড় পাচারের শিকার ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় জকির বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ও মানবপাচারে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ইয়াবা ছাড়াও ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা নিয়মিত মহড়া দেয়। রোহিঙ্গা নারীদের অপহরণেও জড়িত তারা। রোহিঙ্গাদের অন্যখানে পাচার করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই বাহিনী।

কখন থেকে জকির বাহিনী কোণঠাসা

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ২ মার্চ টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি পাহাড়ে র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে ৭ ডাকাত নিহত হয়। তারা সবাই জকির ডাকাতের দলের সদস্য ছিল। এতে ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি সক্রিয় ডাকাত বাহিনী জকির কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে দল গোছাতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টায় ক্যাম্পের উঠতি বয়সের যুবকদের টার্গেট করেছিল।

খুশি সাধারণ রোহিঙ্গারা

টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকালে শিবিরের পশ্চিমে পাহাড়ি এলাকায় ডাকাত গ্রুপের সঙ্গে র‌্যাবের গোলাগুলি ঘটনায় শীর্ষ ডাকাত জকিরসহ তিন নিহত হয়েছে। ডাকাত নিহত হওয়ার খবরে শিবিরে লোকজনের মাঝে স্বস্তি এসেছে। তবে ডাকাত দলের আরও লোকজন জীবীত থাকায় শিবিরের বাসিন্দারা ভয়ে রয়েছেন।’

স্থানীয়রাসহ রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছে, পাহাড়ে আশ্রয়স্থল বানিয়ে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও মানবপাচার করছে ডাকাত দল। তবে তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করছে। আর তাদের সহযোগিতা করছে প্রকাশ্যে থাকা রোহিঙ্গাদের একটা চক্র। এছাড়াও এসব ডাকাতদলের মাধ্যমে কোনও কোনও পাহাড়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বলেও অভিযোগ তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। দিনে পাহাড় আর রাতে ক্যাম্প চষে বেড়ায় তারা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানবপাচার, অপহরণ- এমন কোনও অপরাধ নেই যা তারা করতো না। পুরো ক্যাম্পের মানুষ জকিরের কাছে জিম্মি হয়ে ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একটু শান্ত হতে পারে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও নজরদারি রাখছে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ তিনজনসহ গত ডিসেম্বর থেকে বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট দশজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

আরও খবর