সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম •
আবদুর রহমান বদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং মৌজার বনবিট এলাকায় সাবেক এমপির নামে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় ফরিদ আহমেদের দান করা দশমিক ৩০ একর জমির ওপরই স্কুলের যাবতীয় স্থাপনা থাকার কথা। তবে দান করা ভূমি থেকে প্রায় ২৭০ ফুট দক্ষিণ-পশ্চিমে গিয়ে সংরক্ষিত বনভূমির পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে স্কুলের নতুন ভবন।
সাবেক এমপি বদির নাম ব্যবহার করে এরই মধ্যে সাবাড় করা হয়েছে পাহাড়ের ৬০ হাজার ঘনফুট মাটি।
সরেজমিন পরিদর্শন করে পাহাড় কাটার প্রমাণও পেয়েছে ভূমি অফিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এরপর পরিবেশ আইনে মামলা করা হয়। তবুও থামানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। নোটিশ করলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের শুনানিতে আসছে না অনেকে। তিনজন শুনানিতে এলেও দিতে পারেননি সন্তোষজনক কোনো জবাব।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদ্য বিদায়ী পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, সাবেক এমপি বদির নামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা সমতল ভূমিতে। তবে সেখান থেকে প্রায় ৩০০ ফুট দূরে গিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে স্কুলের নতুন ভবন। এটি করতে গিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড় কাটছে তারা।
এ ব্যাপারে সতর্ক করার পরও পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। তাই অভিযান চালিয়ে মামলাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট টিম। তবুও বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা। সাবেক এমপির প্রভাব খাটিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে এখানে। শুনানিতে যারা এসেছেন এমনটি বলে গেছেন তারাও।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নুরউল্লা নুরী বলেন, সাবেক এমপির নামে স্কুল তৈরির কথা বলে পাহাড় কাটার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি গুরুতর। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, স্কুলের পাশে পাহাড় কাটার বিষয়টি সত্য। তবে স্কুল ভবন তৈরির জন্য নয়। পাহাড় কাটা হচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার জন্য।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, স্কুলের জন্য জমি দান করেছি। এখন আমার বিরুদ্ধেই পাহাড় কাটার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তিনিও দাবি করেন, স্কুলের পাশে থাকা সড়কের জন্য পাহাড় কাটছে সওজ। সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি বিষয়টি জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ পাওয়ার পর বিষয়টি সাবেক এমপিকে জানিয়েছি। তিনি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলতে আবদুর রহমান বদির মোবাইল ফোনে বারবার কল দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
ভূমি অফিসের প্রতিবেদনে যা আছে :স্কুলের নামে কীভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড় কাটা হচ্ছে সেটির বিস্তারিত তুলে ধরে উখিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন দেন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ। ১০ জানুয়ারি পাঠানো এই প্রতিবেদনে তিনি বলেন, উপজেলার জালিয়াপালং মৌজার বিএস ৭৮৭ নম্বর খতিয়ানের বিএস রেকর্ডীয় মালিক আবদুর রহমান সিকদার। তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে এটির মালিক হন আব্দুল হাশেম। এরপর হাশেমের ছেলে ফরিদ আহমেদ মালিক হন। ২০১২ সালেল ১১ নভেম্বর ফরিদ আহমেদ বিএস ৫৬৮৭ নম্বর দাগের দশমিক ৩০ একর ভূমি স্কুলের জন্য দান করেন। এর আগে ৭৮৭ নম্বর খতিয়ানের বিএস ৫৬৮৭ নম্বর দাগের অন্দর দশমিক ৩০ একর ভূমির অনুকূলে স্কুল কর্তৃপক্ষ ২১৫৫ নম্বর খতিয়ান তৈরি করে নামজারি করেন। তবে আবদুর রহমান বদি বিদ্যালয়টি দান করা বিএস ৫৬৮৭ নম্বর দাগ থেকে আনুমানিক ২৭০ ফুট দক্ষিণ-পশ্চিমে বিএস ৫৮৭৫ নম্বর দাগের ওপর অবস্থিত। সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, ৫৮৭৫ নম্বর দাগের ওপর পুরাতন স্কুল ভবনটি অবস্থিত হলেও স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে বিএস ৫৮৭৫ নম্বর দাগ ও তৎসংলগ্ন উখিয়ায় ঘাট মৌজার সংরক্ষিত বনভূমিতে। এজন্য কাটা হয় পাহাড়ও। তিনি আরও বলেন, সাবেক এমপির প্রভাব খাটিয়ে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না কোনো কিছুরই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে যা আছে :স্কুল ভবনের নামে নির্বিচারে পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরও। পরিদর্শক মাহবুবুল ইসলাম সরেজমিন পরিদশন করে ৬০ হাজার ঘটফুট পাহাড় কাটার প্রমাণ পান। সাবেক এমপি বদির নামে স্কুল করার কথা বলে বনবিট এলাকায় জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ৩ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে পাঠানো এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, জালিয়াপালং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে পাইন্যাশিয়া এলাকায় স্কুল করার নামে গত এক বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্কুলের উত্তরে এখনও পাহাড়ের কিছু অংশ অবশিষ্ট আছে। আনুমানিক দুই একরের পাহাড়টি এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এরই মধ্যে ১৫ ফুট উচ্চতায় এবং ৮০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থে প্রায় ৬০ হাজার ঘনফুট মাটি কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন না নিয়েই স্থানীয় ফরিদ আহমেদ ও তার লোকজন এই পাহাড় সাবাড় করছে। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর জয়নাল উদ্দীন, জসীম উদ্দীন, মঞ্জুর আলম, তোফায়েল আহমদ, সাহাবউদ্দীনসহ অজ্ঞাতনামা চার পাঁচজনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করারও সুপারিশ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
শুনানিতেও আসছেন না সংশ্নিষ্টরা : স্কুল ভবনের নামে পাহাড় কাটার অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা না নেওয়ায় উখিয়া উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম, আবদুর রহমান বদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফরিদ আহমেদ, প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম, প্রজেক্ট ম্যানেজার কাজী মইনুল হক, উপজেলা শিক্ষা অফিসার সুব্রত কুমার ধরকে নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ৩ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন এসে তাদের শুনানিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। একইভাবে নোটিশ দেওয়া হয় সরাসরি অভিযুক্ত ফরিদ আহমেদ ও তার সহযোগীদেরও। নোটিশ পেয়ে কেবল প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম, ফরিদ আহমেদ, জসীম উদ্দীন, মঞ্জুর আলম এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রাসেল রানা ও ওহিদুল ইসলাম উপস্থিত হন। অনুপস্থিত ব্যক্তিদের ফের নোটিশ দিতে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
• সমকাল
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-