জসিম উদ্দীন •
কক্সবাজারে অবৈধ ও অপরাধমূলক কাজে প্রায় ৫ হাজার অনিবন্ধিত ‘ড্রাম ট্রাক’ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেবল পাহাড় কাটা ও বালু তোলার কাজে নয়, গরু চুরি ও ইয়াবা পরিবহনেও ব্যবহার হচ্ছে নম্বরবিহীন এসব ড্রাম ট্রাকগুলো।
বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে ছোট বড় ড্রাম ট্রাকের সংখ্যা ৮ হাজারের অধিক। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ), কক্সবাজার অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে মাত্র ১০৫টি ড্রাম ট্রাকের। এরমধ্যে কাগজপত্র নবায়ন করেনি ৮৫টি ট্রাক। এর ফলে কক্সবাজার জেলায় বৈধ ড্রাম ট্রাকের সংখ্যা মাত্র ২৫টি।
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, নম্বরবিহীন এসব ড্রাম ট্রাকের মালিকেরাই মূলত পাহাড় কাটা, বালু তোলা, কাঠ পাচারসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় কোন ড্রাম ট্রাক নেই। তবে বাকি ৭টি উপজেলায় যথাক্রমে রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ড্রাম ট্রাক নিয়ে চলছে নানা অপকর্ম। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ইয়াবা পাচার, চুরি ডাকাতি ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার হচ্ছে ট্রাকগুলো।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমির উদ্দীন বলেন, ‘শুধু ঈদগাঁওতেই ৫ শতাধিক অবৈধ ড্রাম ট্রাক আছে। এগুলো শুধু পাহাড় কাটা, বালু উত্তোলনে ব্যবহার হচ্ছে তা নয়, কক্সবাজার ও ঈদগাঁওতে গড়ে প্রতিদিন ১০-২০টি পর্যন্তু গরু চুরির ঘটনা ঘটছে, যেখানে ব্যবহার হচ্ছে এ ড্রাম ট্রাকগুলো। নম্বরবিহীন ড্রাম ট্রাক অপরাধ করতে চোরের সহায়ক।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন জেলার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ইয়াবা পাচারেও এসব ট্রাকের জুড়ি নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বরাবরের মতই রহস্যজনক কারণে এসব নাম্বারবিহীন ট্রাকগুলো খুব কমই তল্লাশি করা হয়।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, নাম্বারবিহীন এসব ড্রাম ট্রাকের কারণে মূলত পাহাড় কর্তন, বন উজাড়ের ঘটনা বাড়ছে। পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় তারা অসহায়। এ ছাড়াও জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও পরবর্তীতে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কারণে বেশিরভাগ চিহ্নিত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিশেষ টহল টিমের ইনচার্জ এ কে এম আতা এলাহী বলেন, ‘কক্সবাজারে অবৈধ নাম্বারবিহীন ড্রাম ট্রাক বন্ধ করা গেলে পাহাড় কাটা, বন উজাড় বন্ধ করা যাবে। একজনের একাধিক ট্রাক রয়েছে। মালিকরা সিন্ডিকেট করে পাহাড় কাটা ও বন দখলের ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাতে এসব ট্রাকের অপ্রতিরোধ্য বিচরণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকবার কাঠবোঝাই ড্রাম ট্রাক ধাওয়া করতে গিয়েছি। আমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে’
পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য নেচার বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে, কক্সবাজার জেলায় সাড়ে ৮ হাজার ছোট বড় ড্রাম ট্রাক রয়েছে। সংগঠনটির চেয়ারম্যান আ.ন.ম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘গত ১০-১২ বছরের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পাহাড় কর্তন করা হয়েছে। এসব পাহাড় সাবাড় করেছে ড্রাম ট্রাকের মালিকরা। পাহাড়ের মাটি বিক্রি করে তারা কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার বিপরীতে জেলায় সীমাহীন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে।’
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় নাম্বারবিহীন এসব অবৈধ ড্রাম ট্রাকের ব্যবহার বন্ধ করা গেলেই ৭০ ভাগ পাহাড় কর্তন বন্ধ হয়ে যাবে।
নিরাপদ সড়ক চাই কক্সবাজার জেলার সভাপতি জসিম উদ্দীন কিশোর বলেন, গত ২০২০ সালে কক্সবাজার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষ। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে বেপরোয়া ড্রাম ট্রাকের কারণে। তিনিও নাম্বারবিহীন ট্রাক চলাচল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ড্রাম ট্রাকের কয়েকজন মালিক জানান, একটি গাড়ির জন্য প্রতিমাসে মাসোহারা দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির নির্ধারিত ব্যক্তিরা মাস শেষে চাঁদার টাকা নিয়ে যান। হিসেব করলে ৫ হাজার ড্রাম ট্রাক থেকে প্রতিমাসে ৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে (বিআরটিএ) কক্সবাজার সার্কেলের সহকারী পরিচালক উথোয়াইনু চৌধুরী বলেন, ‘ড্রাম ট্রাকগুলো বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে অবৈধভাবে। তাই এসব ট্রাকগুলোর পর্যাপ্ত কাগজপত্র না থাকায় রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নাই। আবার যেসব ট্রাকের কাগজপত্র ঠিক আছে তারাও রেজিস্ট্রেশনে আগ্রহী নয়। কারণ রেজিস্ট্রেশন না করেও গাড়ি চালানো যাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ কঠোর হলে মালিকরা বাধ্য হয়ে ট্রাকের রেজিস্ট্রেশন করতো।’
এদিকে কক্সবাজার সদরে প্রায় এক হাজার, রামুতে ৮ শতাধিক, চকরিয়া-পেকুয়ায় প্রায় দুই হাজার, উখিয়া-টেকনাফে ১২শ’, মহেশখালীতে পাঁচ শতাধিক ড্রাম ট্রাক রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।
জানাগেছে,বৈধ কাগজপত্র ও রোড পারমিট না থাকায় কক্সবাজার সকল ড্রাম ট্রাক ব্যবহার হচ্ছে বেআইনি, ধ্বংসাত্মক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘কক্সবাজারের কোন পুলিশ সদস্য ড্রাম ট্রাক বা অন্য পরিবহন থেকে চাঁদা তোলে না। নাম্বারবিহীন ড্রাম ট্রাকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সড়কে নাম্বারবিহীন গাড়ি চলাচল করলে তা পুলিশ কঠোরভাবে দমন করবে। পাহাড়ে চললে তা দেখতে বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-