বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন (টিকা) প্রয়োগ শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে ঢাকায় এই কর্মসূচির উদ্বোধনের পর আজ রবিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর পাশাপাশি দেশের সবগুলো জেলা ও উপজেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে একযোগে শুরু হচ্ছে এই কর্মসূচি। আর তাতে প্রত্যাশামতোই সাড়া দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ স্বাস্থ্যকর্মী ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিয়মিত বের হওয়া সম্মুখসারির যোদ্ধারা। সরকারিভাবে বলা হয়েছে, আজ সকাল ৮টা থেকে এ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে রাজধানী ঢাকার ৫০টি হাসপাতাল ও সারাদেশের ৯৫৫টি হাসপাতালসহ মোট এক হাজার পাঁচটি হাসপাতালে।
কর্মসূচির আওতায় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ ১৫ ধরনের পেশাজীবীকে সরকারের পক্ষ থেকে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এদের পাশাপাশি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান সব মুক্তিযোদ্ধা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকরা প্রথম ধাপের অগ্রবর্তী তালিকায় রয়েছেন। সুরক্ষা অ্যাপ নিবন্ধন করে সেখানে পাওয়া এসএমএস অনুযায়ী ভ্যাকসিন গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তবে দেশবাসীর সুবিধার্থে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে করোনা ভ্যাকসিনের বুথে গিয়েও রেজিস্ট্রেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও সচেতনতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করবেন এমন কথাও শনিবার সরককারিভাবে জানানো হয়েছে।
দেশের জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে যেহেতু প্রথম দিন, নানা আনুষ্ঠানিকতার কারণে হয়তো স্থানীয় ব্যবস্থাপকরা টিকা গ্রহণকারীদের সুবিধা বিবেচনা করে সময় আগে-পরে করতে পারে। শীতজনিত কারণেও দেশের কোনও কোনও জেলা-উপজেলার হাসপাতালে টিকাদানের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি শুরু হবে সকাল ৯টা বা ১০টায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিন টিকা নেবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি টিকা নেবেন মহাখালীতে অবস্থিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এছাড়া প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেবেন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া টিকা নেবেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে, কেবিনেট সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে, দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন টিকা নেবেন শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে।
এছাড়া বিভিন্ন জেলায় সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদসহ জনপ্রতিনিধিরা টিকা নেবেন। সকালে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন, দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেবেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। এছাড়া যশোর জেনারেল হাসপাতালে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ছাতক ও দোয়ারাবাজার আসনের সংসদ সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংসদ সদস্য ও বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী টিকা নেবেন।
লালমনিরহাটে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এমপি, জেলা প্রশাসক আবু জাফর, পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা, সিভিল সার্জন নির্মলেন্দু রায়সহ মোট ২১১ জন ব্যক্তি করোনা প্রতিরোধী টিকা নেবেন। মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে প্রথম করোনা টিকা গ্রহণ করবেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ। খাগড়াছড়ি জেলা আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রথম টিকা নেবেন সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। হবিগঞ্জে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে করোনার টিকা নেবেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহির। নোয়াখালী জেলায় প্রথম টিকা নেবেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে প্রথম টিকা নেওয়ার কথা রয়েছে সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটুর। এছাড়া বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ডিসি, সিভিল সার্জন, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রথম দিকে টিকা নেবেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। এ মনোভাবের পরিবর্তন এবং টিকা নিতে জনগণকে উৎসাহ দিতেই জনপ্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে টিকা নেবেন।
জেলা প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৪টি উপজেলার পাশাপাশি মহানগরে টিকাদানে ১৫টি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুরুতে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে এ টিকা দেওয়া হবে। চমেকে সকাল ১০টায় টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে অন্তত একশ’ জনকে প্রথম দিন টিকা দেওয়া হবে। চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ অগ্রাধিকার তালিকাভুক্তদের মধ্য থেকে রেজিস্ট্রেশনধারীদের এ টিকা দেওয়া হবে।
খুলনা মহানগরে রবিবার থেকে ১৩টি এবং প্রতিট উপজেলায় তিনটি হিসাবে ২৭টিসহ মোট ৪০টি কেন্দ্রে করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্রে সকাল ১০টায় ভ্যাকসিন গ্রহণের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন এবং শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. অসীত ভূষন দাস ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. পিযুস কান্তি দাস প্রথমে টিকা গ্রহণ করবেন। জেলার ১৩১টি বুথ থেকে একযোগে করোনা টিকা দেওয়া হবে। এরমধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) এলাকায় রয়েছে ১৭টি কেন্দ্র। শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮টি, বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে ৮টি এবং পুলিশ হাসপাতালে রয়েছে একটি বুথ। জেলার ৯ উপজেলায় রয়েছে ১১৪টি বুথ।
টিকা নিতে সিলেটে ইতোমধ্যে সাড়ে ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন। কার্যক্রমের প্রথম দিনেই সিলেটে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও করোনাকালের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের টিকা দেওয়া হবে। সকাল ১০টায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে স্থাপিত বুথে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে। অনলাইনে যুক্ত থেকে এর উদ্বোধন করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এদিন সিলেটের ১২ উপজেলা ও মহানগরের মোট ৪১টি কেন্দ্রে একযোগে শুরু হবে টিকাদান কার্যক্রম।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ অডিটোরিয়ামের বুথে সকাল ১০টায় প্রথম টিকা নেবেন সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু। তারপর সিভিল সার্জন নিজেই টিকা গ্রহণ করবেন। এছাড়া জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই একযোগে রবিবার ১০টা থেকে টিকা দেওয়া শুরু হবে।
এছাড়া বাগেরহাট জেলা প্রশাসক, ফেনী সিভিল সার্জন, লক্ষ্মীপুর সিভিল সার্জন, কুমিল্লায় ফ্রন্ট লাইনারদের একজন, নীলফামারীতে একজন নার্স, নাটোরে এক স্বাস্থ্যকর্মী, নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধিতদের মধ্যে প্রথম উপস্থিত হওয়া ব্যক্তি, গাজীপুরে সংসদ সদস্য বা সিভিল সার্জন, নীলফামারীতে ফ্রন্টলাইনার, মাগুরায় স্টাফ নার্স, মুন্সীগঞ্জে নিবন্ধিতদের মধ্যে প্রথম উপস্থিত হওয়া ব্যক্তি, রাঙামাটিতে সিভিল সার্জন, বরগুনায় সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক, ভোলায় জেলা প্রশাসক, গাইবান্ধায় ফ্রন্টলাইনারদের কাউকে দিয়ে করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা।
এদিকে টিকাদান কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকাতে ৫০টি হাসপাতালে ২০৪টি টিম কাজ করবে, সারাদেশে ৯৫৫টি হাসপাতালে দুই হাজার ১৯৬টি টিম কাজ করবে। মোট এক হাজার পাঁচটি হাসপাতালে দুই হাজার ৪০০টিম কাজ করবে। এছাড়াও ভ্যাকসিন বিষয়ক কার্যক্রমের জন্য টিম প্রস্তুত রয়েছে সাত হাজার ৩৪৪টি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-