সেনা অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রথম হোঁচট

ডেস্ক রিপোর্ট •

রাখাইন রাজ্য থেকে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ওয়ার্কিং কমিটির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বৈঠক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্থগিত হয়ে গেছে। বৈঠকটি বৃহস্পতিবার হওয়ার কথা ছিল।

বৈঠক বাতিলের বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমারে বিরাজমান অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে এটি স্থগিত হয়ে গেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগের পর আলোচনা করে আবার বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ হবে।

এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত সোমবার দেশটির নির্বাচিত নেতা অং সান সু চিকে বন্দি করার পর ক্ষমতা দখল করে। পরে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সু চিকে পুলিশের হেফাজতে রাখার আদেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত।

এই অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি কী হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। অনেকে প্রত্যাশা করছিলেন, এই সামরিক অভ্যুত্থান হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় বড় ধরনের কোনো বাধা হবে না। আবার অনেকে মনে করছিলেন, এর কারণে আলোচনার প্রক্রিয়া থেমে যেতে বা ধীর হতে পারে।

এ দেশে বসবাসকারী ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইনে সেনাবাহিনীর গণহত্যার পেছনে সু চির সরকারের মদদ ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও মিয়ানমারের জেনারেলদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী এই রাজনীতিবিদ। যার জন্য সারা বিশ্বেই তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ফলে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে সু চি আটক হওয়ার পর এখনকার রোহিঙ্গারা তাঁর সরকারের প্রতি কোনো ধরনের সহমর্মিতা দেখায়নি; বরং মনে করে উচিত কাজটিই হয়েছে।

আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা যাচাই-বাছাইয়ের পর মাত্র ৪৮ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার সরকার। এর আগে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। তবে এবার প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার মধ্যে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে; যার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটিও প্রাথমিকভাবে হোঁচট খেল।
এদিকে বুধবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে মিয়ানমার সামরিক সরকারের অধীনে নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমরা প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে চাই। প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখা উচিত। যেমন আমরা ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে প্রত্যাবাসন দেখেছি, এবার কেন নয়? এটি মিয়ানমারের জন্য একটি সুযোগ। তাদের এই সুবিধা নেওয়া উচিত।’

এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সব যোগাযোগের চ্যানেল বন্ধ হওয়ায় তারা এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।’
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা বহাল থাকবে এবং দেশটির সঙ্গে ঢাকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত সোমবার বলা হয়, ‘আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবিচল রয়েছি এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করি, এই প্রক্রিয়াগুলো অব্যাহত থাকবে।’

বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার বিকাশে বিশ্বাসী উল্লেখ করে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকবে বলে আশা ব্যক্ত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন বলেন, ‘সামরিক বাহিনী কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে শাসন করছে এবং অনেক দেশ কেবল নিন্দা করেই তাদের কাজ শেষ করে। আমরা বলেছি আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং আমাদের বার্তা দৃঢ়ভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
ড. মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারে যখন একটি নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক সরকার ছিল, তখন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল এবং কেউ তা মেনে নিতে পারে না।’
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ সব দেশে যোগাযোগ করেছে এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সবাই মুখে কথা দিয়েছে, তবে চীন এগিয়ে এসেছিল। আমরা চীনের নীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারি না, আমরা চীনের ওপর আমাদের আস্থা রেখেছি।’

মোমেন আরো বলেন, ‘কিছু দেশ মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে আরো রোহিঙ্গা আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার সীমান্তকে সুরক্ষিত রেখেছে। অতীতে আমাদের জনগণ রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছিল। এখন তারা আর স্বাগত জানানোর মানসিকতায় নেই।’
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গত মঙ্গলবার বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে কথা না বললেও চীন সরকার মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করায় চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।’

পররাষ্ট্র সচিব আরো জানান, তাঁরা মহাপরিচালক পর্যায়ের পূর্ব নির্ধারিত যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে মতামত পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের আলোচনার অগ্রাধিকার ছিল এবং চীন এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে।

সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমারের সঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক করতে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত অবশিষ্ট সম্মত রোডম্যাপটি অনুসরণ করতে চায়। আমরা এটি চীনা পক্ষকে জানিয়েছি।’

আরও খবর