আজ থেকে চার বছর আগে মিয়ানমারের শীর্ষস্থানীয় সংস্কারক ইউ কো নি’কে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার কঠোর সমালোচক। ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) আইনি পরামর্শক এবং অং সান সু চির সহযোগী ছিলেন তিনি।
মুসলিম আইনজীবী ইউ কো নি ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বিদেশ থেকে ফেরার পর ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে প্রকাশ্যে খুন হয়। এই খুনের চক্রান্তে ছিলেন মিয়ানমারের সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডির বিপুল জয়ের পরে অং সান সু চির জন্য (সু চির প্রয়াত স্বামী মাইকেল আরিসসহ তার সন্তানরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তিনি দেশটির নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্ট হতে না পারায়) রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতার পদ বের করার কৃতিত্ব ইউ কো নি’র। তার এমন ভূমিকার কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেনাবাহিনী। এনএলডি সরকারের প্রথম বছরেই ভাড়াটে খুনির বুলেট ৬৩ বছর বয়সী এ আইনজীবীর প্রাণ যায়।
মিয়ানমারের নাগরিকরা বহু দশকের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের পর বেসামরিক সরকার ক্ষমতা নেওয়ায় ওই সময় আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। ইউ কো নি তখন অনুভব করেছিলেন যে, দেশ একটি টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে। তার ছেলে কো থান্ট জিন ওও বলেন, ‘আমার মনে আছে (২০১৫ সালের) নির্বাচনের পরে বাবা কী সক্রিয় ও খুশি ছিলেন!’
২০০৮ সালে সেনাবাহিনী প্রণীত সংবিধানে ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন আইনজীবী ইউ কো নি। হত্যার আগে তিনি এনএলডিকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন দলটির গঠনতন্ত্র সংস্কারে।
আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি। সেনাবাহিনী নিযোগ করা মিয়ানমারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ঘাতকরা ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ব্যক্তিগত ক্ষোভ’ থেকে খুন করেছে। তারা ইউ কো নি’র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘বিরক্তি’ ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই মন্তব্য খুনের প্রকৃত কারণ আড়াল করার প্রয়াস হিসেবে প্রতীয়মান হয়। আইনজীবী ইউ কো নি’র সংস্কার পদক্ষেপ ঠেকাতে আরও শক্তিশালী কেউ এ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকে।
ইউ কো নি’র হত্যা মামলায় চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ইউ নে উইন ঘাতককে ধরার চেষ্টা করায় তাকেও যিনি হত্যা করেন সেই বন্দুকধারী কি লিন এবং হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী সাবেক লেফটেন্যান্ট অং উইন জাওকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে সহযোগী সাবেক সামরিক গোয়েন্দা ক্যাপ্টেন জেয়া ফিয়োকে পাঁচ বছরের এবং অং উইন জাওকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল অং উন খাইং, যাকে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে, তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর এখনও গোপন সুরক্ষাসহ বহালতবিয়তে আছেন বলে জানা গেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, তার অবস্থান সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
ইউ কো নি’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইউ ন লা বলেন, বিচার চলাকালীন কোনো মোটিভ পাওয়া যায়নি। অং উন খাইং গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনার কোনো কিনারা হবে বলে তিনি মনে করেন না।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দু’জনকে গতবছর প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, এ প্রক্রিয়াও ইউ ন লা’কে ভীত করেছে।
কো থান্ট জিন ওও বলেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রায় ঘোষণার পর থেকে এই মামলার বিষয়ে তাদের পরিবারের অবস্থান বদলায়নি। আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এই হত্যার বিচার চলাকালীন ভিকটিমের পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী এবং ইউ কো নি’র সহকর্মী উ খিন মাং হাতায় বলেন, ‘অং উন খাইংকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত মামলা শেষ হবে না। আদালত তাকে পলাতক ঘোষণা করেছে। তাকে আদালতে হাজির করা এবং এই চক্রান্তের পিছনে কারা ছিলেন তা শনাক্ত করার মূল দায়িত্ব পুলিশের।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের পথে একটি ত্যাগ। আমাদের অবশ্যই তার মৃত্যু বৃথা যেতে দেওয়া উচিত হবে না। আমাদের সবার গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে সামনে এগিয়ে নেওয়ায় কাজ করা উচিত।’
ইরাবতি পত্রিকায় প্রকাশিত সান ইয়ামিন আংয়ের বিশ্লেষণটি অনুবাদ করেছেন মিছিল খন্দকার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-