মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান : সুচিকে হটানোয় খুশি কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা

বিশেষ প্রতিবেদক •

মিয়ানমারে বিভিন্ন সময়ে নিপীড়নের শিকার হয়ে সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সু চিরও দায় দেখেন রোহিঙ্গারা। তাদের মতে, মিয়ানমারে আবার সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। এরপরও অং সান সু চিকে হটানোর ঘটনায় রোহিঙ্গারা খুশি।

মিয়ানমারে ‘সু চি যখন বন্দী ছিলেন, তখন রোহিঙ্গারা তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল। অথচ ক্ষমতায় আসার পর সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়নে মদদ দেন। সু চির জন্যই আমরা জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।’—বলছিলেন রোহিঙ্গা সিরাজুল ইসলাম (৪৫)। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অং সান সু চিকে আটক করার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিরাজুল এ মন্তব্য করেন।

এ দিকে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানকে ঘিরে বাংলাদেশের সীমান্তের তিন উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের ২০০ কিলোমিটারে সতর্কাবস্থায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড।

সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের উপস্থিতিতে এক বিবৃতি পাঠ করছেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে। তিনি একজন জেনারেল। সামরিক অভ্যুত্থানের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

কক্সবাজার শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। সোমবার সকালে আশ্রয়শিবিরের ডি-৪ ক্যাম্পের একটি চায়ের দোকানে বসে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান আলোচনা করছিলেন ২৫-৩০ জন রোহিঙ্গা। অং সান সু চি ও তাঁর সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোয় কমবেশি সবাই মহাখুশি।

জানতে চাইলে রোহিঙ্গা সিরাজুল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘সু চি ক্ষমতায় থাকলে জীবনেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ফিরে পাবে না। জন্মভূমিতেও ফিরতে পারবে না।’ রোহিঙ্গা নাজির হোসেন (৫৫) বলেন, ‘সু চির উচিত শিক্ষা হয়েছে। তাঁকে আরও আগে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।’

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা শুরু হলে পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগেও মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশয় নিয়েছে।

সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উখিয়ার মধুরছড়া, জুমশিয়া, বালুখালী, লম্বাশিয়া, কুতুপালং, টেকনাফের নয়াপাড়া, শালবন, জাদিমুরা আশ্রয়শিবির ঘুরে শতাধিক রোহিঙ্গা নেতা ও নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা হয়। সবাই তাঁদের এই অবস্থার জন্য সু চিকে দায়ী করেন। রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য—অং সান সুচির সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকার করেনি। এ কারণে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার একজনও রাখাইনে ফিরতে পারেনি।

মধুরছড়ার একটি পাহাড়ের ঢালে ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত ছোট্ট ঘরে স্ত্রী, দুই ভাই-বোন ও চার সন্তান নিয়ে থাকছেন রোহিঙ্গা আমজাদ হোসেন। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে। আমজাদ বলেন, সু চির সরকার নাগরিকত্ব দেয়নি বলে এত দিন তিনি মিয়ানমার ফিরতে পারেননি।

শর্ত পূরণ ছাড়া একজন রোহিঙ্গাও ফিরতে রাজি না হওয়ায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর দুই দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিফল হয়।

উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিষয়ে সক্রিয় আছে ১০টির বেশি রোহিঙ্গা সংগঠন। অং সান সু চিসহ তাঁর সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ায় অধিকাংশ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা খুশি।

রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আরএসইউ), রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক (আরএসএন), রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফর লিগ্যাল অ্যাকশন (আরওয়াইএলএ), আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস(এআরএসপিএইচ), রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফেডারেশন (আরওয়াইএফ)-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা বলেন, সু চিকে হটিয়ে মিয়ানমারে পুনরায় সামরিক জান্তা ক্ষমতায় এসেছে। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। এরপরও অং সান সু চিকে হটানোর ঘটনায় তাঁরা খুশি।

এসব সংগঠনের নেতারা দাবি করেন, ১৯৬০ সাল থেকে রোহিঙ্গা জনগণ পরিকল্পিতভাবে সরকার এবং চরমপন্থী রাজনীতিবিদদের গণহত্যার শিকার হয়ে আসছেন। মিয়ানমার সরকারের যৌথ সশস্ত্র দলগুলো রোহিঙ্গাদের গ্রাম, বাড়িঘর পুড়িয়েছে, হত্যা-ধর্ষণ করেছে। সবশেষ ২০১৫ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিষিদ্ধ করেছে মিয়ানমার সরকার।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, ঘুমধুম, চাকঢালার ১০-১২ কিলোমিটার স্থল সীমান্তে সকাল থেকে টহল জোরদার করেছে বিজিবি। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ৮০ কিলোমিটার নাফ সীমান্তেও নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত আরও ৩০-৪০ কিলোমিটারে টহলে আছে কোস্টগার্ড ও বিজিবি।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, বিকেল ৩টা পর্যন্ত সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। মিয়ানমারের কেউ যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও টহল জোরদার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় মিয়ানমারের কেউ যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে কোস্টগার্ড নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে তৎপর রয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের ঘটনায় বাংলাদেশ সতর্ক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি।

রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. তারিক ইসলাম তারিক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক আছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আজ সোমবার ভোরে অং সান সু চি ও তাঁর ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটকের পর দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়ে সু চি সরকারকে হটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অং সান সু চি ও তাঁর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তকেও আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।

আরও খবর