হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া •
সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার একমাত্র আশ্রয়স্থল মাটির ঘর। একসময় উখিয়া উপজেলার গ্রামীণ মাটির ঘর ছিল ঐতিহ্যবাহী বসবাসের কেন্দ্রস্থল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন সেই মাটির ঘরটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এখানকার মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন এসেছে।
এক সময় উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত নজরকাড়া মাটির একতলা কিংবা দোতলা বাড়ি। শুধু মাটির বাড়িই নয়, ছিল ধান চাল রাখার জন্য মাটির তৈরি গোলা ঘর ও কুঠি। এক সময়ে কুড়ে ঘরে থাকা গাড়িতে পান সিগেরেট বিক্রি করা উখিয়ার সেই ছেলেটি আজ মাটির ঘরে নেই। চায়ের দোকানে পরটা, রুটি বানানো এবং গাড়ির হেলপার ও চালক যারা ছিল তারাও আজ গাড়ি বাড়ির মালিক। আগে দিনে এনে দিনে খেত সিএনজি চালাতো তারা কেউ আর মাটির ঘরে থাকে না। এরা একেকজন বহুতল ভবনের মালিক।
আলাদিনের চেরাগের মতো ইয়াবা ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এসব এখন শুধুই স্মৃতি। প্রবীনদের মুখের কথায় একমাত্র অবলম্বন। হঠাৎ করে বড় লোক হয়ে যাওয়া বিলাশ বহুল গাড়ি বাড়িসহ কোটিপতির সংখ্যা উখিয়াতে কম নেই। আবার অনেকেই জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। ইয়াবা নিয়ে ধরাও পড়েছেন।
উখিয়ার বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাটির তৈরি ঘর সৌন্দর্য এবং অত্যন্ত আরামদায়ক। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও এক সময় পরিবার পরিজন নিয়ে সখের বসেবসবাস করতেন। এখন এই মাটির ঘর ভেঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে ইটের তৈরি পাকা দালান। মাটির ঘরগুলো গরমে শীতল আর শীতের উষ্ঞ। বর্তমানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মতো। এ অঞ্চলে এক সময় মাটির ঘর হিসেবে খ্যাত ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। ইয়াবা ব্যবসার অবৈধ টাকা আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব মাটির ঘর হারাতে বসেছে।
আর এ বিষয়ে রত্নাপালং ইউনিয়নের তেলিপাড়া গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এন আলম বলেন, আমার ছেলেবেলা এবং কিশোর বয়স এই মাটির ঘরে বাস করে আমি বড় হয়েছি। এই মাটির ঘর তৈরিতে সাধারণত এটেল বা আঠালো মাটি দিয়ে পানির সঙ্গে মিশিয়ে কাদায় পরিণত করা হয়। সেই কাদা ২০ থেকে ২৫ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। এ দেয়াল তৈরি করতে বেশ সময় লাগে। কারণ এক সঙ্গে বেশি উচু করে দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার ২ থেকে ৩ ফুট উচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে আবার তার ওপর একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে দেয়াল ১২ থেকে ২০ ফুট উঁচু হলে বেশ কিছুদিন ধরে রোদে শুকানো হয়। এরপর এই দেয়ালের ওপর তালের আড়ং, কাঠের চাল তৈরি করে খড় বা টিন দিয়ে ছাউনি দেয়া হয়। একটি মাটির ঘর তৈরি করতে প্রায় ৯০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
মাটির ঘরের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পিত উখিয়া চাই এর আহবায়ক সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, মাটির ঘর শীত গরম উভয় মৌসুমে বেশ আরামদায়ক। তবে ভূমিকম্প বা প্রবল ঝড় না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। অনেক সময় মাটির ঘর দোতলা পর্যন্ত করা হয়। এ সমস্ত ঘর বেশি বড় হয় না। মা, চাচি ও গৃহিনীরা তাদের নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় নিপুণভাবে কাদা দিয়ে লেপে মাটির ঘরের দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এখন আর সেই মাটির ঘর চোখে পড়ে না বললেই চলে। তবে নিতান্ত গরিবেরায় দু,একটা ঘর টিকিয়ে রেখেছেন। এখানকার অনেকেই মরণ নেশা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে বনে গেছেন কোটিপতি। তাই তো ধানের চাষের জমি ক্রয় করে বহুতল ভবন তৈরির হিড়িক পড়েছে। আগামী প্রজন্ম মানুষের কাছে মাটির ঘর রুপকথার গল্পের মতো মনে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-