বাংলানিউজ •
সেন্টমার্টিন ঘুরে এসে: বাংলায় একটা প্রচলিত কথা আছে— কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কথা আর কাজে মিল না থাকার বিষয়টি বোঝাতেই এমন উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা নির্দেশনাও যেন সেই উদ্দীপকের সার্থক ও বাস্তব উদাহরণ।
সম্প্রতি সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটকদের জন্য ১৪টি নির্দেশনা দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে জারি করা সেই নির্দেশনা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেসব নির্দেশনার অনেক কিছুই বাস্তবে পালন করা হচ্ছে না।
নির্দেশনা বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপও কার্যত পরিলক্ষিত না হওয়ার অভিযোগ আছে।
পরিবেশ সংরক্ষরণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ধারা-৪ এর ক্ষমতাবলে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখতে এসব নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।
নির্দেশনার প্রথমটিই ছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৈকতে মোটরবাইক, সাইকেল, রিকশা-ভ্যানসহ সব ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা। সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরে এই নির্দেশনার পালন হতে দেখা যায়নি। রিকশা-ভ্যান না চললেও সৈকতে মোটরবাইক ও সাইকেল চলতে দেখা যায়। এমনকি দ্বীপের পশ্চিম অংশে রীতিমতো বাণিজ্যিকভাবে সাইকেল ভাড়া দেওয়া হয় পর্যটকদের কাছে।
নির্দেশনার ৯ ও ১০ নম্বরে ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এমনকি ছেঁড়াদ্বীপে স্পিড বোট, কান্ট্রি বোট, ট্রলার ও অন্যান্য জলযানে ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণ এবং এসব জলযান ছেঁড়াদীপে নোঙ্গর করাও নিষিদ্ধ করা হয়। এ নির্দেশনাও মানার কোনো বালাই দেখা যায়নি বাস্তবে।
উপরন্তু দ্বীপের মূল জেটি ঘাটের পাশাপাশি পশ্চিম পাশে সরাসরি সাগর থেকে ছেঁড়াদীপের উদ্দেশে ট্রলার ছেড়ে যায়। এ জন্য টিকিটের মাধ্যমে জনপ্রতি ২৫০ টাকা আদায় করা হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম অংশ থেকে ছেঁড়াদ্বীপ যেতে কোস্টগার্ডের একটি টহল ট্রলার থাকলেও ছেঁড়াদীপে যেতে তাদের পক্ষ থেকে কোনো নৌযানকে বাধা দিতে দেখা যায়নি।
তবে ট্রলারে থাকা যাত্রী ও পর্যটকরা লাইফ জ্যাকেট পড়েছেন কিনা বা ট্রলারের মাঝি পর্যটকদের লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করেন কিনা সে বিষয়টিতে কোস্টগার্ডের জোরালো ভূমিকা পর্যটকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। খোদ ছেঁড়াদ্বীপে জনসাধারণ প্রবেশ নিষিদ্ধ সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে পর্যটকদের সঙ্গে কথা বললে তারা নির্দেশনার প্রয়োগ না থাকাকে দায়ী করেন। অন্যদিকে পর্যটকের চাপ থাকায় নির্দেশনা অমান্য করে হলেও পর্যটকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান দ্বীপের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
রাজধানী ঢাকা থেকে আগত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফজলুর রহমান রনি বলেন, আমরা তো এখানে এসেছি ঘুরতে। ছেঁড়াদ্বীপ খুবই আকর্ষণীয় একটা জায়গা। এখন সেখানে যাওয়া যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে এত মানুষ এত ট্রলারে করে যাচ্ছে কীভাবে? যদি যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকে আমরা তো আর যাব না।
অন্যদিকে সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিয়ে যাওয়া এক ট্রলারের নাবিক রফিক আলী বলেন, আমরা এই দ্বীপে থাকি। পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর ওপরেই আমাদের আয় হয়। এখন তাদের ভ্রমণ নিষেধ করে দিলে আমরা চলব কীভাবে? আমরা তো কোনো ক্ষতি করি না। যখন যে নির্দেশনা দেয় সেটা মেনে চলি, পর্যটকদেরও বলি। পর্যটকরা যদি কোনো ক্ষতি করে তাহলে তাদের সেগুলোর বিষয়ে সতর্ক করা হোক। আমাদের রুটিরুজি বন্ধ না হোক।
এদিকে পরিবেশের ক্ষতি না করে কীভাবে ভ্রমণ আরও সহজ করা যায় তার দাবি জানিয়েছেন পর্যটকেরা। ফাতিমাতুজ্জোহরা হিরা নামে এক পর্যটক বলেন, এখান থেকে প্রবাল, শামুক বা অন্যান্য জিনিস নেওয়া নিষিদ্ধ। আমরা নিচ্ছি না। সমুদ্রে বা সৈকতে প্লাস্টিকের কিছু ফেলা নিষেধ, আমরা সেগুলোও করছি না। হয়তো কেউ কেউ করছেন, সে জন্য ক্ষতি হতে পারে। এ জন্য ভ্রমণ নিষিদ্ধ না করে যারা এসব কাজ করেন তাদের দিকে আরও কঠোর নজরদারি দেওয়া যেতে পারে। যেমন কেউ যদি সাগরে জাহাজ থেকে পাখিদের চিপস দেয় তাহলে সেই ব্যক্তিকে এই দ্বীপ ভ্রমণে একটা সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু এভাবে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করা ঠিক না। এতে করে আমরা পর্যটকেরা বিপদে পড়ি।
সেন্টমার্টিনের প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং অধিদপ্তরের পরিকল্পনা পরিচালক সোলায়মান হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নির্দেশনার বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। সেন্টমার্টিনে না যাওয়ার জন্য পর্যটকদের নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ সেখানে গিয়ে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ নষ্ট করছে। গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে সবাইকে অবগত করার জন্য যেন ভবিষ্যতে আইন প্রয়োগ করা হলে তারা বলতে না পারেন যে, এ বিষয়ে নির্দেশনা তারা জানেন না। প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ কিন্তু সেটা কী কেউ মানে? মানুষদের নিজেদের দায়িত্ববোধ থাকতে হবে সেখানে না যাওয়ার। তবে এই নির্দেশনা না মানার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অ্যাকশনে যাওয়া হবে। এরজন্য কোস্টগার্ড, নেভি এবং পুলিশের সাহায্য লাগবে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। প্রয়োজনে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও আমরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।
কবে নাগাদ অ্যাকশনে যাওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে সোলায়মান হায়দার বলেন, কবে অ্যাকশনে যাওয়া হবে সেটা আমরা নোটিশ দিয়ে যাব না। এটুকু বলতে পারি যে, ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে যে কেউ যেকোনো সময় আটক হতে পারেন এবং তাকে জেলে যেতে হবে। সরকার এ বিষয়ে কঠোর হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে। আর ছেঁড়াদ্বীপে তো আমরা একেবারেই পর্যটক যেতে দেব না।
দ্বীপে যাওয়ার জন্য জাহাজ এবং ট্রলারের মতো ব্যবস্থা রেখে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সোলায়মান হায়দার বলেন, আমরা সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা সীমিতকরণ করব। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসবে। তার আগ পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আমরা গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছি, সামনে আরও করব। ফল পেতে সময় লাগবে। মানুষদেরও উচিত সেখানে আর না যাওয়া।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-