ইয়াবার মূল্য পরিশোধ হয় দুবাই,থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে : কক্সবাজারে পাচার বন্ধ করা যাচ্ছেনা যে কারণে!

ইয়াবা (ফাইল ছবি)

অনলাইন ডেস্ক  • সদ্য বিদায়ী বছর ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে র‌্যাব,পুলিশ, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, ও কোস্ট গার্ড মিলে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা উদ্ধার করেছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৫ পিস। এছাড়াও এই সময়ে দেশে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত হয়ে আরও ৩০ কোটি পিস ইয়াবা ঢুকেছে।

সূত্রমতে, মিয়ানমারে প্রতি পিস ইয়াবার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় গড়ে ৩০ টাকা। এই হিসাবে উদ্ধার হওয়া ও উদ্ধারের বাইরে থাকা প্রায় ৩৩ কোটি পিস ইয়াবার মূল্য ৯৯০ কোটি টাকারও বেশি, যা গত ১১ মাসে পাচার হয়েছে মিয়ানমারে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত দেশে ইয়াবা আসছে। গত ১১ মাসে প্রায় ৩০ কোটি পিস ইয়াবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে। এই ইয়াবার দাম আনুমানিক ৯৯০ কোটি টাকা।

তিনি জানান, এসব ইয়াবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। কিছু সংখ্যক ধরা পড়লেও ইয়াবার বড় চালানগুলো অধরাই থেকে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তৎপর থাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।

গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশি মাদক কারবারিরা ইয়াবার মূল্য পরিশোধের জন্য বেছে নিচ্ছে দুবাই, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরকে। বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বড় বড় ডিলাররা ইয়াবার দাম পরিশোধ করে থাকে। হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকাই ডলার হয়ে চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। এছাড়া ওষুধ, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়েও নিয়ে আসা হচ্ছে মাদক।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আহসানুল জব্বার বলেন, ‘আগে ইয়াবা নিয়ে মিয়ানমার তেমন কোনও তথ্য দিতো না। কিন্তু সম্প্রতি এক বৈঠকে ইয়াবা সম্পর্কে দেশটি বেশকিছু তথ্য দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে। এছাড়া পারস্পরিক তথ্য বিনিময়ের বিষয়েও কথা দিয়েছে মিয়ানমার। অভিযান চালিয়ে ইয়াবার বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।’

মাদক নিয়ন্ত্রণে র‌্যাবের অভিযান বেগবান আছে উল্লেখ করে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীসহ গডফাদারদের তালিকা ধরেই অভিযান চালানো হয়। যারা ধরা পড়ে তাদের দেওয়া বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতেই অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। বিমানবন্দর দিয়েও ইয়াবা পাচার হচ্ছে। এছাড়া ইয়াবার টাকা বিভিন্ন পন্থায় দেশের বাইরে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ইয়াবার গডফাদাররা দেশে কিংবা বিদেশে অবস্থান করে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইয়াবার টাকা অটোমেটিক্যালি গডফাদারদের কাছে চলে যায়। অন্তরালে থেকেই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে শেল্টার দিয়ে থাকে গডফাদাররা। ইয়াবার বাংলাদেশি বড় কারবারিরা মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাঠাচ্ছে মিয়ানমারে। এত কিছুর পরও কক্সবাজারের বড় বড় ডিলাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়। ধরা পড়ে মূলত ক্যারিয়ার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের মাধ্যমেও টাকা লেনদেন করে। তবে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট থাকলেও পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধু-বান্ধবের অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন করে থাকে।

মূলত, লেনদেনের বিষয়টি আড়াল করতেই কোনও একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে আসছে এক একটি চক্র। খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় ডিলার পর্যন্ত সবাই একটা চেইন মেন্টেইন করে ইয়াবার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে, কিংবা হাতে হাতে একে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়। তদন্তে এসব ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনে অসামঞ্জস্য পেলে সে বিষয়ে তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আহসানুল জব্বার বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আটক করা হয়।’

ইয়াবার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেনে অসামঞ্জস্য পেলে অনুসন্ধান করে মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ইয়াবার কারণে অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনই সামাজিক অবস্থারও অবনতি হচ্ছে।’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য এর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে বিচারবহির্ভূত হত্যা সমাধান হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বাহক আটক হলেও আড়ালে থেকে যায় ইয়াবার গডফাদাররা।’

বিগত বছরগুলোতে ইয়াবা উদ্ধারের পরিসংখ্যান

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সব সংস্থা মিলে ২০০৯ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ২৮৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

এরপর ২০১৪ সালে উদ্ধার করা হয় ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৯ পিস।

২০১৫ সালে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে উদ্ধার হয় ২ কোটি ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮১ পিস,

২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩ পিস,

২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।

আর সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।

এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, দেশে ইয়াবার জোগান বেড়েই চলছে।

আরও খবর