সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বেড়াজালে বিএনপি

জাগো নিউজ •

একযুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে চলছে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। সুযোগ পেলেই একে অপরকে সরকারের ‘দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার হাতে কার্যত দলের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে পুরো হাওয়া ভবনের সিন্ডিকেট ও দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতা সিনিয়র নেতাদের পদে পদে অপমান করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এমন অবস্থা সৃষ্টি করছেন যে, সিনিয়ররা যেন দল ত্যাগে বাধ্য হন।

আলোচনা রয়েছে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের মহাসচিব হলেও কার্যত দল পরিচালিত হয় দফতরের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের মাধ্যমে।

সম্প্রতি দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে শোকজ করার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো মির্জা ফখরুলের কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতার মালিক রিজভী! আর এ কারণেই কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এমনকি গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজ করে চিঠি পাঠিয়েছেন রিজভী।

সম্প্রতি তিনি অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় গল্প প্রচলিত ছিল, রিজভী আহমেদের চিকিৎসার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলের দফতর। এটা তিনি ছাড়বেন না। কার্যত তাই দেখা গেল, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই হঠাৎ অফিসে চলে এসে দফতর দখলে নিয়েছেন তিনি! আর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সব ‘নিয়ম-নীতি উপেক্ষা’ করে।

দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যদি কাউকে আগে শোকজ করতে হয় সে তো রিজভীকে করতে হবে। তিনি সব সময়ই সিনিয়রদের ও দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজের মন মতো দল পরিচালনা করছেন। দলের সিনিয়র নেতা এমনকি দলের মহাসচিব কোনো বিষয়ে কথা বললেও রিজভী আবার প্রেস কনফারেন্স করে একই বিষয়ে কথা বলেন। যাতে মনে হয়, তিনিই বিএনপির একক নেতা। সব ত্যাগ তার একারই, অন্য কারো কোনো ত্যাগ নেই। এমনকি দলের পদ-পদবিও দিয়ে থাকেন তিনি এবং ওইসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। গঠনতন্ত্র মতে যা অবৈধ।

তারা আরও বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে তিনি এসব কাজ করে থাকেন। এবং নিজেকে কার্যত বিএনপির মহাসচিব মনে করেন। তার এই কাজে সহযোগিতা করে থাকে হাওয়া ভবনের সেই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটরা। দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে কার নির্দেশে শোকজ করা হয়েছে, সিনিয়র কোনো নেতা তা জানে না।

এদিকে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাকর্মীদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

দলের মহাসচিব পদে বারবার আলোচনায় থাকা চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক নিষ্ক্রিয় সিনিয়র নেতা আক্ষেপ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, এমনিতেই এখন আর কোনো সিনিয়র সাংবাদিক বিএনপির পক্ষে কথা বলেন না, বলতেও চান না। অতীতে তারা এই রকম দলের ‘টোকাইদের’ থেকে অপমানিত হয়েছেন বলে অনেকটা নীরবই হয়ে গেছেন। আর সাংবাদিক অঙ্গন এখন প্রায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দখলে রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী বলে যারা পরিচয় দেন তাদের অধিকাংশই জামায়াত সমর্থক। এর মধ্যে শওকত মাহমুদের মতো একজন প্রাজ্ঞ ও জনপ্রিয় সাংবাদিক নেতাকে শোকজ করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। দলকে এখনই ভেবে দেখতে হবে, রিজভী আহমেদ গং আসলে কি বিএনপির কল্যাণ চায় নাকি সরকারের সঙ্গে আপসের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে ধ্বংস করে জামায়াত সমর্থকদের পুনর্বাসন করতে চায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এক দশকের বেশি সময় পেলেও দল গোছাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা তো রয়েছেই। আর এ কারণেই সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে বিএনপির। শোকজ ইস্যুতে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা আবারও দৃশ্যমান হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের শীর্ষ এক নেতা বলেন, বর্তমান গতিশীল রাজনীতির যুগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান একেবারেই সেকেলে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন এবং অবশেষে ভুল সিদ্ধান্ত নেন। তাদের নানা অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলে নেতাকর্মীদের ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দলের শীর্ষ দুই নেতৃত্বের ব্যর্থতায় বিএনপি প্রায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। আর এ সময়ে রাজনৈতিক মাঠে বিএনপিকে বাঁচিয়ে রাখতে দুই ভাইস চেয়ারম্যান সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও তাদের শোকজ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক অজ্ঞতা প্রসূত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দণ্ডপ্রাপ্ত লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান এরই মধ্যে দলের যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন। তার একগুঁয়ে নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণেই বিএনপি বারবার হোঁচট খাচ্ছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তারেকের মতো ‘অকালপক্ব’ ও ‘অপরিণত’ নেতার অধীনে রাজনীতি করার কিছুই নেই। বিএনপিকে বাঁচাতে অচিরেই রিজভীর অপসারণ দরকার বলেও মত দেন তিনি।

রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত শোকজের জবাব শওকত মাহমুদ নীরবে দিলেও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম গত শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই দিয়েছেন। সেখানেও তিনি তাকে রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে শোকজ করায় অপমানিত বোধ করেছেন বলে জানান। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে রাখার জন্য একটি মহল সক্রিয় রয়েছে।

দলের মধ্যে কথা উঠেছে, তাহলে রিজভী আহমেদ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান ও কোণঠাসা করে কী হাসিল করতে চান? নাকি তিনি বিএনপিকে মুক্তিযোদ্ধাবিহীন দলে পরিণত করতে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এগুলো দলের চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ভাবতে হবে। অন্যথায় এই দলকে আরও বেশি মাশুল দিতে হতে হবে।

এদিকে রিজভী আহমেদের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই রিজভী তার অনুগত অনুগামী হয়ে বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করছেন।

সূত্র জানায়, দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে হাফিজ উদ্দিন আহমেদের শোকজের জবাবে পদত্যাগের ইঙ্গিতে উল্টো অস্বস্তিতে ফেলেছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। এই অবস্থায় হাফিজ উদ্দিনকে বোঝাতে দলের ভেতরে তৎপরতা চলছে। হাফিজের পক্ষ থেকে দলের প্রতি ক্ষুদ্ধ প্রকাশ আসতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ১৭ ডিসেম্বর গুলশান কার্যালয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম আলোচনা করেন। তারা দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে নোটিশ যাই হোক তার প্রতি চেয়ারপারসনের ইতিবাচক মনোভাবের কথা ইতোমধ্যে হাফিজ উদ্দিনকে জানানো হয়েছে।

হাফিজের দেয়া নোটিশের জবাবে বিএনপি সন্তুষ্ট কি-না জানতে চাইলে নোটিশে স্বাক্ষরকারী দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ জানান, বিষয়টি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তুলে ধরা হবে। সিদ্ধান্ত নেবেন দলের নীতি নির্ধারকেরা।

এদিকে, শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো এজেন্ডা ছিল না বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে বৈঠকে কেউ কোনো কথাও তোলেননি।

আরও খবর