মুক্তার হার ও খোদাভীরু যুবক

মক্কায় এক যুবক বাস করত। পরহেজার, খোদাভীরু, তবে খুবই গরিব। একদিন যুবকটি জীবিকার উদ্দেশে মক্কার গলি দিয়ে হাঁটছিল। হঠাত্ সে লক্ষ্য করল—মণিমুক্তা খচিত গলার একটা হার পড়ে আছে। আশপাশে আর কেউ নেই, তাই হারটা উঠিয়ে নিল। যুবক হারের মালিকের খোঁজে হেরেমে এলো।

এমন সময় একটা ঘোষণা তার কানে এলো—‘আমি একটা হার হারিয়েছি। কোনো দয়ালু ভাই পেয়ে থাকলে, আল্লাহর ওয়াস্তে হারটি ফিরিয়ে দেবেন।’

যুবকটা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনার হারটা দেখতে কেমন, বর্ণনা দিন তো?’ বর্ণনা মিলে গেলে যুবক হারটা মালিকের কাছে হস্তান্তর করলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, লোকটা হারখানা ফিরে পেয়ে একটা টু-শব্দও করল না। সোজা গটগট করে হেঁটে চলে গেল। যুবককে সামান্য ধন্যবাদটুকুও দিল না। যুবক আল্লাহর কাছে দোয়া করল:—ইয়া আল্লাহ! আমি যদি এই সামান্য কাজটুকু আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই করে থাকি, আপনি আমার জন্য এর চেয়েও ভালো প্রতিদান জমা করে রাখুন। আমিন।

কিছুদিন পর যুবক রুজি-রোজগারের উদ্দেশে জাহাজে চড়ে বসল। তাকদিরের এমনই লিখন, যুবকের জাহাজ পড়ল ঝড়ের কবলে। পুরো জাহাজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হাতের কাছে যে যা পেল ওটা ধরেই ভেসে রইল। যুবকও একটা কাঠের টুকরা ধরে ভাসতে ভাসতে একটা দ্বীপে গিয়ে ঠেকল। সেই দ্বীপে সে একটা মসজিদ খুঁজে পেল। যুবকের মন খুশি হয়ে উঠল। মসজিদে গিয়ে শোকরানা ও ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় করল। যুবকের আশ্রয়ের দরকার ছিল কিন্তু তার তো যাওয়ার আপাতত কোনো জায়গা ছিল না, ভবঘুরে। মনে মনে মসজিদে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। সে মসজিদে একটা কোরআন শরিফ দেখতে পেল। বসে বসে কালামে পাক তিলাওয়াত করতে শুরু করল। অচেনা যুবককে পবিত্র কোরআন শরিফ পড়তে দেখে আশপাশের সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল।

অবাক হয়ে প্রশ্ন করল:—আপনি কোরআন পড়তে পারেন? জি, পারি। তারা বলল:—আমাদের কাছে এই কোরআন কারিম অনেক দিন ধরে পড়ে আছে। আমরা কোরআন পড়তে পারি না। আমরা এটাকে পরম যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এক নাবিকের কাছ থেকেই আমরা এ কোরআনটা কিনে ছিলাম। আমাদের এই দ্বীপে আগে একজন ছিলেন, তিনি এই কোরআন পড়তে পারতেন। ঠিক করা ছিল, তিনিই সবাইকে কোরআন শিক্ষা দিতেন। একবার তিনি হজে গেলেন। আর ফিরে আসেননি। এখন আপনি আমাদেরকে, আমাদের সন্তানদেরকে মেহেরবানী করে পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিন। যুবক দ্বীপবাসীদেরকে কোরআন শিক্ষা দিতে সম্মতিজ্ঞাপন করল।

দ্বীপের বাচ্চাদেরকে কোরআন কারিম শিক্ষা দিতে লাগল। তাদেরকে অন্যান্য বিদ্যাও শেখাতে থাকল। কিছুদিন পর এলাকার মুরুব্বিরা বললেন—‘আমাদের এলাকায় একজন ইয়াতীম মেয়ে আছে, সর্বগুণে গুণান্বিতা। আপনি কি তাকে বিয়ে করতে রাজি হবেন?

‘আমার কোনো আপত্তি নেই’, যুবক লাজুক মুখে সম্মতি জানাল। বিয়ে হয়ে গেল। বাসররাতে স্ত্রীর সঙ্গে যুবকের সাক্ষাত্ হলো। যুবক নববধূকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সে লক্ষ করল, তার বিবির গলায় মক্কায় কুড়িয়ে পাওয়া সেই হারটি ঝুলছে। যুবক বিস্ময়ের সঙ্গে বিবির কাছে জানতে চাইল, ‘এই হার তোমার কাছে কীভাবে এলো? নববধূ লাজুক মুখে উত্তর দিল, ‘আমার আব্বু। সেবার হজে গেলেন। হজের সফরে আমার জন্য একটি হার কিনলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে হারটা হারিয়ে গেল। কিন্তু এক মহত্ ব্যক্তির বদান্যতায় হারটা ফিরে পেলেন। আব্বু সব সময় তার জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন আর বলতেন’। ইয়া আল্লাহ! মক্কার এই মহত্ ব্যক্তির মতো আমার মেয়ের জন্য এমন একজন স্বামী মিলিয়ে দিন’। যুবকের দু চোখ বেয়ে দরদর করে পানি ঝরতে লাগল। ইয়া আল্লাহ্! আপনি সবচেয়ে বড় হিকমতওয়ালা! আপনার মহিমা বোঝা বান্দার সাধ্য কী!

বি.দ্র. যুবকের নাম—কাজি আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল বাকী আল আনসারী, যিনি মারিস্তানের কাজী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন, মৃত্যু: ৫৩৫ হি:। সূত্র :সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড: ২০, পৃ: ২৩,

লেখক : শামসুদ্দিন যাহাবী

আরও খবর