মামলায় এগিয়ে বিএনপি, সম্পদে আ’লীগ প্রার্থীরা

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা বেশি। দলটির বেশির ভাগ প্রার্থীর বিরুদ্ধেই মামলা আছে।

অপরদিকে দু-চারজন ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নামে কোনো মামলা নেই। তবে দলটির বেশির ভাগ প্রার্থীই সম্পদশালী। অর্থবিত্তের দিক থেকে এ দলের প্রার্থীরা এগিয়ে। দুই দল মিলিয়ে ২০ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এতে দেখা গেছে, পৌরসভা নির্বাচনে ‘স্বশিক্ষিত’ বা ‘স্বাক্ষরজ্ঞান’ আছে- এমন শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরাও মনোনয়ন পেয়েছেন। দু’দলই এমন লোকদের মনোনয়ন দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না, এটা নির্বাচনী শর্তও নয়।

অনেক প্রার্থী আছেন, যাদের শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড নেই কিন্তু নিজের বুদ্ধি, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের, সমাজের ও রাষ্ট্রের কাজে ভালো ভূমিকা পালন করছেন। আমরা প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার বিষয়টা বেশি বিবেচনা করি।

একই বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সত্য। যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা নেই তারাও মাঠে নামতে পারছেন না।

সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠ দখল করে আছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সর্বোপরি প্রার্থীর নিজের সফলতা, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে তার অবদান বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়।

হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসভা নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মো. আবুল মুনছুরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্বশিক্ষিত’। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা বিচারাধীন। পেশায় ব্যবসায়ী এ প্রার্থীর বার্ষিক আয় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা।

তার হাতে নগদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা, দুই লাখ টাকা মূল্যমানে অলঙ্কার, এক লাখ ৬০ হাজার টাকার আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী। এছাড়া দুই তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি রয়েছে তার। অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদিউল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে কোনো মামলা নেই, অতীতেও ছিল না। পেশায় ব্যবসায়ী এ প্রার্থীর সম্পদও বেশি।

তার কৃষি খাত থেকে বছরে তিন হাজার টাকা, ব্যবসা থেকে পাঁচ লাখ ১০ হাজার ৪৩০ টাকা, মেয়র পদের সম্মানী চার লাখ ৮০ হাজার টাকা ও ব্যাংক সুদ ৪১ হাজার ১৪ টাকা আয় রয়েছে। সম্পদের মধ্যে নগদ দুই লাখ ৯৫ হাজার ৮০৩ টাকা, ব্যাংকে জমা চার লাখ ৭ হাজার ২৯৭ টাকা, বিভিন্ন মেয়াদে জমা আট লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা ও অলঙ্কার রয়েছে দেড় লাখ টাকা মূল্যমানের। এছাড়া এক লাখ টাকা মূল্যমানের ইলেকট্রনিক ও আসবাবপত্র রয়েছে।

স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে কৃষি জমি আট গণ্ডা, অকৃষি দুই গণ্ডা, এক হাজার ১২০ বর্গফুট আকারের দালান ও ২০০ বর্গফুটের সেমিপাকা বাড়ি আছে। ছেলের কাছ থেকে রেমিটেন্স হিসেবে পেয়েছেন নয় লাখ ৯২ হাজার ১৬১ টাকা। তার নামে ব্যাংক ঋণ রয়েছে ১৫ লাখ টাকা।

কুষ্টিয়ার খোকসা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এই দুই দলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপির প্রার্থী রাজু আহম্মেদের বিরুদ্ধে বর্তমানে ৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি খোকসা থানায় ও একটি কুষ্টিয়া মডেল থানায়। বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরকদ্রব্য আইনসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এসব মামলা দায়ের হয়।

এর আগেও তার বিরুদ্ধে ৬টি মামলা ছিল। যদিও সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন। বিএ পাস রাজু আহম্মদের বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন মাত্র দুই লাখ টাকা। তার হাতে নগদ ১০ হাজার টাকা ও ব্যাংকে এক লাখ টাকা জমা রয়েছে। এর বাইরে সাড়ে ১৩ শতক অকৃষি, পৌনে ৫ শতক কৃষি, যৌথ মালিকানায় দোতলা বাড়ির একতলা এবং আসবাবপত্র রয়েছে। তার কোনো দায়দেনা নেই বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। স্ত্রীর নামে ৩৫ হাজার টাকা, সাত ভরি স্বর্ণ ও আসবাবপত্র রয়েছে।

অপরদিকে এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. তারিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। অতীতে একটি মামলা হলেও সেখান থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। সম্পদের দিক থেকে বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে আছেন। তার বার্ষিক আয় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এছাড়া নগদ দুই লাখ ২০ হাজার টাকা, ৫৫ দশমিক ০৬ শতক কৃষি জমি, ৮ শতক অকৃষি জমি ও টিন শেড বাড়ি রয়েছে। তার স্ত্রীর নামে ৪৬ লাখ টাকা ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে জমা আছে। এছাড়া রয়েছে ৬ ভরি স্বর্ণ। তারিকুল ইসলামের ২০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মাসুদুজ্জামান মাসুকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্বশিক্ষিত’ উল্লেখ করেছেন।

কাউন্সিলর থেকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এ প্রার্থীর স্থাবর সম্পদের মধ্যে ২০ শতক কৃষি জমি, আট শতক অকৃষি জমি ও চার শতক জমির ওপর একতলা বিল্ডিং রয়েছে। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীর স্থাবর সম্পদের মধ্যে একটি পাকা ঘর রয়েছে।

যৌথ মালিকানায় ১৩ দশমিক ৯১ একর কৃষি, ১০৫ শতক অকৃষি ও ১৮০ শতক জমি আছে। এসব জমির ৪৮/৭ অংশের মালিক তিনি।

অপরদিকে বিএনপির মনোনয়নে লড়ছেন এমএফ আহমেদ অলি। এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে ১০টি মামলা রয়েছে। সবকটি মামলাই ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দায়ের করা। এসব মামলার মধ্যে পাঁচটি বিচারাধীন, দুটি স্থগিত ও বাকিগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।

নবম শ্রেণি পাস এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আগেও পাঁচটি মামলা দায়ের হয়েছিল। ওইসব মামলা থেকে অব্যাহতি ও খালাস পেয়েছেন তিনি।

খুলনার চালনা পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মো. আবুল খায়ের খানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন’। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একটি মামলা। তবে সেটি ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে স্থগিত। পেশায় ব্যবসায়ী এ প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সনাত কুমার বিশ্বাসের চেয়ে বেশি।

বিএনপির প্রার্থীর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ এক লাখ টাকা ও ব্যাংকে জমা পাঁচ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১১ একর কৃষি জমি, দশমিক ৮১ একর অকৃষি জমি, এক তলাবিশিষ্ট দালান ও বাড়ি একটি। ব্যাংকে তিন লাখ টাকা ঋণও আছে তার। অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সনাত কুমার বিশ্বাসের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। পেশায় ব্যবসায়ী এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। অতীতে দুটি মামলা হলেও সেখানে খালাস পেয়েছেন তিনি।

অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ২০ হাজার টাকা, ১৫ তোলা স্বর্ণ ও আসবাবপত্র এবং স্থাবর সম্পদের মধ্যে ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া চার একর কৃষি জমি ও দশমিক ৫০ একর অকৃষি জমি রয়েছে। তার নয় লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে।

ঢাকার ধামরাই পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম কবিরের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলমান। আগে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হলেও সেগুলোতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থী দেওয়ান নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে চারটি বিচারাধীন ও একটি উচ্চ আদালত স্থগিত করেছেন। এর আগে তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়, যেগুলো থেকে খালাস বা অব্যাহিত পেয়েছেন তিনি। এ পৌরসভায় প্রধান দুই দলের প্রার্থীই স্নাতক পাস।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে লড়ছেন আনোয়ারুল ইসলাম। এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা চলমান। এর আগেও একটি মামলা দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। ওই মামলায় খালাস পান তিনি। এ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। পেশায় তিনি সাংবাদিকতা উল্লেখ করেছেন। তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন তিন লাখ ৫০০ টাকা।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল ইমাম মো. কামরান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বর্তমানে কোনো মামলা নেই। অতীতে তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা হলেও সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। পেশায় ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের এ প্রার্থীর বার্ষিক আয় ব্যবসা থেকে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা, মেয়র হিসেবে সম্মানী তিন লাখ ৬৩ হাজার ৫১৬ টাকা ও কৃষি থেকে দুই হাজার টাকা।

তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে, কুড়িগ্রামের পৌরসভা নির্বাচনে। এ পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর কারোর বিরুদ্ধেই বর্তমানে মামলা নেই। এখানে বিএনপির প্রার্থীর তুলনায় সরকারি দলের প্রার্থীর সম্পদ বেশি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. কাজিউল ইসলাম পেশায় ব্যবসায়ী। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা নেই ও অতীতেও মামলা হয়নি।

তার বার্ষিক আয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে, দুই লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের অকৃষি জমি, ১৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের তিনতলা বাড়ি ও ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি কাঁচাবাড়ি। অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম এমএসসি পাস। পেশায় শিক্ষক। তার বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ ৮ লাখ ৩২ হাজার ৮১১ টাকা, একটি মোটরসাইকেল, ৫ ভরি স্বর্ণ ও আসবাবপত্র।

আরও খবর