জেলা প্রতিনিধি •
ছুটি পেলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক উপেক্ষা করে ভীড় জমে দেশের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। ব্যতিক্রম ঘটেনি বিজয় দিবসের ছুটিতেও। এই ছুটিতেও যথারীতি পর্যটকে সরগরম হয়ে উঠেছে কক্সবাজার সৈকত ও সংলগ্ন এলাকা। সম্প্রতি দুর্গাপূজা ও প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটিতে সমুদ্র সৈকত লোকারণ্য হয়ে উঠত।
কিন্তু শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় কক্সবাজারে পর্যটকের আগমন কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিজয় দিবসের ছুটি উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা থেকে পূর্ণ হয়ে গেছে সৈকত তীরের হোটেল-মোটেল-কটেজ ও গেস্ট হাউজগুলো। বিজয় দিবসের প্রথম প্রহর থেকে সৈকতে লোকসমাগম আরও বাড়তে থাকে।
বুধবার সমুদ্র সৈকতে বালি দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য উদ্বোধন হলে সেখানে ভীড় করেন দর্শনাথীরা। এতে লোকারণ্য হয়ে ওঠে পুরো সৈকত তীর।
ঘুরে দেখা গেছে, বেড়াতে আসা পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। আর নিরাপত্তার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ এবং জেলা প্রশাসন।
কলাতলীর হোয়াইট অর্কিড হোটেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) রিয়াদ ইফতেখার জানান, করোনাকালীন স্তব্ধ পর্যটন এলাকা গত ১৭ আগস্ট খুলে দেয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই ভ্রমণ পিপাসুরা কক্সবাজার ছুটে আসছেন। নানা দিবস ও সরকারি ছুটিতে টানা বুকিংও হয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ে গত ১৫ দিন ধরে পর্যটক আসা কমে গিয়েছিল। বিজয় দিবসের ছুটিকে কেন্দ্র করে আবার পর্যটকে ভরে গেছে কক্সবাজার।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে পর্যটক আগমন শুরু হয়। অনেকে এসেছেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। আগামী শুক্র-শনিবার পর্যন্ত থাকতে আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। পর্যটকের উল্লাসে কক্সবাজার মুখরিত হলে ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পান।
কক্সবাজারের দিগন্ত ট্যুরিজমের মালিক ইয়ার মুহাম্মদ জানান, পর্যটকরা সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি দরিয়ানগর, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানীর পাথুরে সৈকত, রামু বৌদ্ধ বিহার, মহেশখালী আদিনাথ মন্দিরসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতেও ঘুরছেন। যাচ্ছেন সেন্টমার্টিনেও। আগামী শনিবার পর্যন্ত সেন্টমার্টিনগামী চারটি জাহাজের টিকেট অগ্রিম বিক্রি হয়ে আছে।
সি-সেইফ লাইফগার্ড সুপারভাইজার মুহাম্মদ ওসমান বলেন, একদিকে বিজয় দিবসের ছুটি অন্যদিকে বালিয়াড়িতে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশালাকৃতির বালি ভাস্কর্য। এটি দেখতে পর্যটকদের পাশাপাশি সৈকতে ভীড় বাড়িয়েছে স্থানীয় মানুষজন। তবে, সিংহভাগ ভ্রমণকারীই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। আবার অনেকে সমুদ্রে নামার সময় মুখে থাকা সার্জিক্যাল মাস্কটি ফেলেই চলে যাচ্ছেন। পর্যটকের ভীড় বাড়ায় করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রতিনিয়ত মাইকিং করা হচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল- মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজে রয়েছে। এগুলোতে একত্রে লক্ষাধিক পর্যটকের সঙ্কুলান সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে সাপ্তাহিক ছুটিতেও প্রায় লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। শতভাগ বুকিংয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে তারকা হোটেলগুলো।
কক্সবাজার সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্র জানায়, পর্যটকদের সেবা নিশ্চিতে সর্তক অবস্থায় দায়িত্বপালন করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। মোতায়েন রাখা হয় অতিরিক্ত পুলিশও। পর্যটক হয়রানি রোধে পর্যটন স্পটগুলোকে সিসিটিভি ক্যামরার আওতায় আনা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত সাধারণ চিকিৎসা ও খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে সমুদ্র সৈকতে। গোসলের সময় বিপদাপন্ন পর্যটকদের রক্ষার্থে সর্তক অবস্থায় রয়েছেন লাইফগার্ড কর্মীরা।
ফেনীর দাগনভুঞা থেকে আসা পর্যটক ইব্রাহিম কবির বলেন, করোনা পরিস্থিতির পর দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়ির সবাইকে নিয়ে প্রায় ৮ মাস পর বিজয় দিবসকে উপলক্ষ করে কক্সবাজারে এসেছি। সৈকতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি বাড়তি আনন্দ দিচ্ছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খুব মজা করছি।
জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ ইসলাম জানান, পর্যটক হয়রানি বন্ধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশনা পালন হচ্ছে কিনা তদারকি চলছে নিয়মিত। সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ ১১টি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র (ইনবক্স)। করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বদা সচেতনতা মূলক মাইকিং ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সবসময় সর্তকাবস্থায় রয়েছে পুলিশ। পর্যটকদের অনাকাঙ্খিত হয়রানির শিকার রোধে, পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে এবং পর্যটক বেশে পুরুষ-নারী পুলিশ সদস্যরা সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটক নিরাপত্তায় সৈকত এলাকায় পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের বিশেষ রেসকিউ টিম, ইভটিজিং কন্ট্রোল টিম, ড্রিংকিং জোন, দ্রুত চিকিৎসাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তায়। সৈকতে বিচ বাইক নিয়ে টহল অব্যাহত রেখেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। রয়েছে ৩টি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী। কন্ট্রোল রুম, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারসহ পুরো সৈকতে পুলিশের নজরদারির আওতায় রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শংকার মাঝেও বিপুল পরিমাণ পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা রোধের পাশাপাশি পর্যটনটাও এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। সেভাবেই পর্যটন সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যটক হয়রানি বন্ধে মাঠে
রয়েছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
সবাই আন্তরিক হলে পর্যটন ব্যবসা ঠিক রেখে করোনা রোধ সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-