কক্সবাজারে পাহাড়ে ও বনে বাদাড়ে লনটানা: ব্লু-ইকোনমিতে খুলতে পারে নতুন দুয়ার

ডেইলি কক্সবাজার •

একসময় লনটানাকে মনে করা হত একটি আগ্রাসী আগাছা হিসাবে। একে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলো লক্ষ কোটি ডলার খরচও করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় এই আগাছার ক্যান্সার, যক্ষা, ম্যালেরিয়া, হাঁপানি, একজিমা প্রতিরোধীসহ বহু ওষুধী গুণের কথা চাওর হয়ে যাওয়ার পর ‘ধিকৃত’ আগাছা এখন মহা আদরনীয় ‘লনটানা’। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের ‘অলংকার’ হয়ে সারাবছরই এই সড়ককে ফুলে ফুলে সুশোভিত রাখা এই লনটানাই ব্লু-ইকনোমিতে নতুন দুয়ার খুলতে পারে বলে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ ও মহেশখালীর বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত এবং সৈকত সংলগ্ন পাহাড়গুলোতে ব্যাপকভাবে এই উদ্ভিদটি জন্মাতে দেখা যায়। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক নাম লনটানা ক্যামারা। তবে কক্সবাজারে এটি মগকেড়া, মগগুলা ও মক্কাগুলা নামে পরিচিত।

গবেষকরা জানান, উদ্ভিদটি ভারতে চালিত গবেষণায় একটি এথনো মেডিসিন বা গার্হস্থ্য ওষুধ হিসাবে দেখানো হয়েছে। লনটানার পাতাতে ০.২% অপরিহার্য তেল থাকে। এর রস অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল বা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হিসাবে এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করে। ছত্রাক প্রতিরোধী ও কীটনাশক হিসাবেও পাতার রস কার্যকর। শুকনো ফুলগুলিতে ০.০৭% অত্যাবশ্যকীয় তেল থাকে যা মূলত ক্রিয়োাফিলিনের মতো সাইক্লিক্লিক টারপিন (৮০%) এবং এল,এ-ফিল্যান্ড্রেন (১০-১২%) সমন্বিত থাকে। এ গাছের ছালে থাকে ০.০৮% ল্যানটেনিন। তবে কক্সবাজারেও এর ঐতিহ্যগত ঔষধী ব্যবহার দেখা যায় বলে জানান বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, একটি আগ্রাসী উদ্ভিদ হিসাবে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও বনে বাদাড়ে ব্যাপকভাবে লনটানা দেখা যায়। হার্বাল বা ভেষজ ওষুধ হিসাবে এর ব্যবহার বাড়ালে লনটানা দেশের ব্লু-ইকনোমি জোরদারে ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেন, সাধারণত: ক্ষেতখামার ও বসতভিটাকে গবাদিপশুমুক্ত রাখার জন্য বেড়া হিসাবেই কক্সবাজারের বাসিন্দারা লনটানার চাষ করে। এছাড়া বায়োশিল্ড বা জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসাবেও সমুদ্র সৈকতে লনটানার চাষ করা হয়। তবে শারীরিক ক্ষত বা জখমের এন্টিসেপ্টিক হিসাবে লনটানার পাতার রসের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও এখানে অন্যান্য ওষুধী ব্যবহার তেমন নেই বললেই চলে।

লনটানার ওষূধী ব্যবহারের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, পৃথিবীর নানাদেশে ক্যান্সার, যক্ষা, ম্যালেরিয়া, হাঁপানি, একজিমা, কফ-পিত্ত রোগ, আলসার, ঠান্ডা, অতিরিক্ত জ্বরসহ নানা জটিল পীড়ায় এর অসংখ্য ব্যবহার আছে। এর পাতা বিষাক্ত বলে কোনো প্রাণী তা খেতে পারে না। লনটানা যে-কোনো মাটিতে জন্মাতে পারে। এমনকি লবণাক্ত অঞ্চলেও। অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসস্তুূপের মধ্য থেকেও দ্রুত গজিয়ে ওঠে লনটানা। পাখিরা এর বীজ দূরদূরান্তে নিয়ে যেতে পারে।

গবেষকরা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লনটানার পাতা পঁচিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করা হচ্ছে। গবেষণা চলছে বায়ো-ব্রিক্স তৈরিরও। আবার লনটানার শরীরে অর্ধেকের বেশি কার্বন থাকায় তাকে কম্প্যাক্ট করে কয়লা তৈরিও করা হচ্ছে। কাগজ ও ফাইবারের কাঁচামাল হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে লনটানার ডাল-পালা-কান্ড। দক্ষিণ ভারতে লনটানার ডাঁটা দিয়ে ঝুড়ি তৈরি করা হয়। আধুনিক ফার্নিচার প্রযুক্তিতেও লনটানা ব্যবহৃত হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।

লনটানা ভারবেনা বা ভারবেনাস পরিবারভূক্ত একটি ফুলের প্রজাতি। ‘ল্যান্টানা’ জেনাস নামটির উদ্ভব হয়েছে একটি ইউরোপীয় গাছ থেকে যা ভিন্ন গোত্রের হলেও এর ফুলের অবয়বের সঙ্গে বেশ মিল আছে লনটানার। লনটানা ফুলের ছত্রমঞ্জরী দেখতে খুব সুন্দর। এর ফুলে নানারকম প্রজাপতি দেখা যায়। ‘ক্যারোটিন’ থাকার কারণে প্রথমে ফুল হাল্কা হলুদ রঙের হয়। এ সময় ফুলে পরাগায়ন হয় এবং পরাগায়নের পরেই মধুভান্ড শেষ হয়ে যায়। এরপর ফুলের রং বদলাতে থাকে। পাখিরা এর ফল খুব স্বাদ করে খায়, বিশেষ করে যে-সব মুনিয়ার বুকে সাদা রঙের মাছের আঁইশের মতো নকসা থাকে। একটি উদ্ভিদ বছরে প্রায় ১২ হাজার বীজ উৎপাদন করে। সুগন্ধযুক্ত পাতাগুলি দিয়ে চা তৈরিও করা যায়। পৃথিবীতে লন্টানার প্রায় ১৫০টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়।
কথিত রয়েছে, ইউরোপে ওলন্দাজরাই প্রথম লন্টানা চাষ শুরু করে। এশিয়া ও ওশেনিয়ায় এটি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া একটি আগাছা হিসাবেই বেশি পরিচিত। এর আদি নিবাস ক্রান্তীয় আমেরিকা। বর্তমানে এশিয়ার বাংলাদেশ ও ভারতসহ পৃথিবীর ৫০টিরও বেশি দেশে পাওয়া যায়।

রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, এন্টি মাইক্রোবায়াল রেজিস্টেন্স (এএমআর) বা ঔষধপ্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও লনটানা গবেষণায় কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এটি এখন পর্যটন ও পরিবেশগত সেবার পাশাপাশি বিশাল অর্থনৈতিক সেবাও দিতে পারবে।

আরও খবর