ডেস্ক রিপোর্ট •
মাদক মামলার বিচার পৃথক ট্রাইব্যুনালে হবে নাকি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হবে, তা নিয়ে আইনি জটিলতায় পার হয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। এ জটিলতায় এ সংক্রান্ত মামলার জট আরও বেড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, দেশের আদালতগুলোয় ২০১৮ সালে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো মাদক মামলা বিচারাধীন ছিল, এখন ১ লাখ ৮০ হাজার। দুই বছরে বেড়েছে ৪০ হাজার। আর সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার।
সর্বশেষ গত ১৯ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধনী আনে সরকার। সংশোধনীতে জেলায় জেলায় পৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজদের বিচারের দায়িত্ব প্রদানের বিধান উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন আইন তৈরির আগে যেসব আদালতে মাদক মামলার বিচার হতো, এখন আবার সেখানেই বিচার হবে। বিচার করতে পারবেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতগুলো এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতও। সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতকে মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে মাদক মামলার বিচারের বিধান উঠিয়ে দিয়ে দ্রুত এ ধরনের মামলার বিচার শেষ করা সম্ভব হবে না। কারণ এমনিতেই সাধারণ আদালতগুলোয় হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন। তার ওপর নতুনভাবে মাদক মামলার বিচারের দায়িত্ব পাবেন আদালতগুলো। ফলে যেভাবে অন্যান্য মামলার বিচার বছরের পর বছর
এমনকি এক যুগেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না, তেমনি মাদক মামলার বিচারও বিলম্বিত হবে। আর মামলা নিষ্পত্তিতে যত বিলম্ব হবে বিচারপ্রার্থীর সময়, অর্থব্যয় ও দুর্ভোগও তত বাড়বে। আবার দুই বছর আগে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, বিচার বিলম্বের কারণে মূলত সেই যুদ্ধেও ভাটা পড়তে পারে। এ কারণে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে ও মাদক নির্মূলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু আমাদের সময়কে বলেন, ‘একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিচারক আছেন, তা দিয়ে মামলার জট কমানো সম্ভব নয়। বর্তমানে যে সংখ্যক বিচারক আছেন, তা তিন গুণ বাড়াতে হবে। কমপক্ষে তিন হাজার বিচারক থাকতে হবে। অতিসত্ত্বর নতুন বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। নইলে কোনোভাবেই মামলার জট কমবে না বলে সাবেক এ আইনমন্ত্রী মনে করেন।
জানা যায়, সরকার ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করে ২০১৮ সালে নতুন আইন তৈরি করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধানসংবলিত এই নতুন আইন তৈরির পর শুরু হয় জটিলতা। আইনে প্রতিটি জেলায় পৃথক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়। অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের মাদক মামলার বিচারের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয় ওই আইনে। কিন্তু জটিলতার কারণে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং বিচারের দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে গেজেট জারি বন্ধ ছিল দুই বছর ধরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের নতুন আইনে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। অতিরিক্ত জেলা জজকে মাদক মামলার বিচারের দায়িত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকার ফলে এই জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই আইন অনুযায়ী পাঁচ পিস ইয়াবার মামলা হলেও একজন অতিরিক্ত জেলা জজকে বিচার করতে হবে। আর একজন অতিরিক্ত জেলা জজ বিচার করলে তার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থীকে হাইকোর্টে আপিল করতে হবে। আর এখানেই বাধে জটিলতা। এ ছাড়া জেলায় জেলায় পৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে বিচারকসহ অন্যান্য জনবলেরও দরকার ছিল। কিন্তু বিচারক ও জনবলস্বল্পতা না কাটিয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে আইন সংশোধনের কথা চিন্তা করে। এ জন্য গত ১৯ নভেম্বর সংশোধনী বিল পাসের প্রতিক্রিয়ায় সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম বলেন, ‘১৮ থেকে ২০ সাল দুটি বছর। যখন আইন তৈরি করব কেয়ারফুল হওয়া দরকার। ট্রাইব্যুনাল করতে পারব না। কিন্তু আইন করলাম!’
জানতে চাইলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করতে হলে আইন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। ন্যায়বিচার, দেশ পরিচালনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। স্পষ্টতই এগুলোর অভাবে নিত্যনৈমিত্তিকভাবে অনেক রকম জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সমস্যার মূলে আছে সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আইন ও বিচার বিভাগে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ এবং এ বিষয়ে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অযোগ্যতা। এসব সমস্যার সমাধান না করা গেলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার রাজনীতিবিদদের বুলিতেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে। তিনি বলেন, মামলার জট নেই, পৃথিবীতে এমন দেশ নেই। এটা খুবই পরিচিত সমস্যা। সব দেশই সমাধান করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে মামলাজটকে একটি সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়নি, ফলে সমাধানেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
এদিকে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের নতুন আইন কার্যকর করা হয়। অথচ আইন অনুযায়ী দীর্ঘদিন মাদক মামলার বিচারের জন্য জেলায় জেলায় পৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা কিংবা সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে এ ধরনের মামলার বিচারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়নি। এ বিষয়টি লক্ষ করে গত বছরের ৮ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৯ জুলাই থেকে সারাদেশে হাজার হাজার মাদক মামলার বিচার বন্ধ হয়ে যায়। বিচার বন্ধ থাকে একটানা কয়েক মাস। এর পর হাইকোর্ট সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি গত বছরের ২৮ অক্টোবর হাইকোর্ট মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত অথবা গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিকল্প আদালতকে ক্ষমতা না দেওয়া পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫(২) ধারা অনুযায়ী মাদক মামলার বিচার করার নির্দেশ দেন। এর অর্থ ২০১৮ সালে আইন তৈরির আগে যেসব আদালতে মাদক মামলার বিচার হতো, সেসব আদালতে বিচার করার বিধান ফিরে আসে। এর পর বাধ্য হয়ে সরকার গত ১৯ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন বিল-২০২০ সংসদে পাস করে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-