ডেস্ক রিপোর্ট •
করোনাভাইরাসে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন কি না বা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি না, পৃথিবীব্যাপী গবেষণার পাশাপাশি তর্ক-বিতর্কও চলমান।
‘করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই’- অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথা বলেছিলেন গত ২৮ জুলাই। সেখানে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্য আমাদের দেশীয় চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। বিতর্কেরও অবসান হয়নি। ড. বিজন তার অবস্থানে অটল। পরবর্তীতেও তিনি একাধিকবার এই প্রতিবেদককে এ কথা বলেছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
গত ১৭ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি কয়েক বছর এমনকি কয়েক দশক পর্যন্ত কার্যকর থাকতে পারে। অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকলে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে না।
গত ২০ নভেম্বর একটি ব্রিটিশ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একবার যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের অন্তত ছয় মাসের মধ্যে আবারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে।
ব্রিটিশ গবেষণায় নেতৃত্বদানকারীদের একজন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব পপুলেশন হেলথের অধ্যাপক ডেভিড ইরি বলেছেন, ‘এটি অবশ্যই একটি সুসংবাদ। অধিকাংশ করোনা রোগীর অন্তত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবারও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই।’
এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ড. বিজন কুমার শীল আজ রোববার সকালে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের নতুন রূপ ২০১৯ সালের করোনাভাইরাস। সার্স ভাইরাসের সঙ্গে যার মিল ৮৩ শতাংশ। সেই সময় আমরা সার্স ভাইরাস সিঙ্গাপুরের ল্যাবে তৈরি করেছি, শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করেছি। যা দিয়ে সিঙ্গাপুর সফলভাবে সার্স ভাইরাস মোকাবিলা করেছে।’
‘আমি নিজেকে বড় বিজ্ঞানী হিসেবে দাবি করি না। কিন্তু, এই দাবি করি যে, করোনাভাইরাস অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের কাছে নতুন হলেও, আমার কাছে নতুন নয়। করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য, গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আগে থেকেই অনেকের চেয়ে খানিকটা বেশি হলেও ধারণা ছিল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ভাইরাসটিকে জানি। সেই গবেষণা, জানা ও অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদেরকে বলেছিলাম, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা কারো দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই’, বলছিলেন ড. বিজন।
২০০৩ সালে সিঙ্গাপুরে সার্স ভাইরাস নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছিল। সেই গবেষণার অংশ ছিলেন ড. বিজন। সার্স ভাইরাস আক্রান্তদের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল, তা দীর্ঘ মেয়াদে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় রেখেছিল।
‘সিঙ্গাপুরের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস আক্রান্তের শরীরে যে অ্যান্টিবডি মেমোরি কোষ (টি-সেল) তৈরি হয়েছিল, তা ২০২০ সালেও বিদ্যমান ও কার্যকর রয়েছে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার গত ১৫ জুলাই সেই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে,’ বলেন ড. বিজন।
দ্বিতীয়বার কেন আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. বিজন বলেন, ‘এইডস জাতীয় রোগে আক্রান্ত ও নিয়মিত স্টেরয়েড গ্রহণ করতে হয়, এমন অতি নগণ্য সংখ্যক রোগী ছাড়া দ্বিতীয়বার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ শরীরের অ্যান্টিবডি নির্দিষ্ট সময় পর চলে যায়, এ কথা যেমন সত্য তেমনি চলে যাওয়ার আগে অ্যান্টিবডি তৈরির মেমরি সেল শরীরে উৎপাদন করে দিয়ে যায়। করোনাভাইরাস যদি পুনরায় শরীরে প্রবেশ করে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে ওই মেমরি সেল অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় বা হত্যা করে।’
কিন্তু, বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শোনা যায়, অমুক ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ তিন-চারবার আক্রান্ত হয়েছেন, এমন সংবাদও জানা যায়।
এমন সংবাদ বা সন্দেহের কারণ কয়েকটি, উল্লেখ করে ড. বিজন বলছিলেন, ‘প্রথমত–আর টি পিসিআর টেস্টে সাধারণত ৩০ শতাংশ ভুল রিপোর্ট আসতে পারে। প্রথমবারের পরীক্ষায় যখন নেগেটিভ আসল, তখন হয়ত তিনি পজিটিভ ছিলেন। একইভাবে পজিটিভ আসলেও তিনি নেগেটিভ থাকতে পারেন। সন্দেহ বা বিতর্কের এটা একটি কারণ। তবে আমার ধারণা সবচেয়ে বড় কারণ হলো, করোনাভাইরাস সাধারণত শরীরে প্রবেশ করে নাক-মুখ দিয়ে। আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির শরীরে পুনরায় ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। করোনাভাইরাস শরীরে বহন করা মানেই কোভিড-১৯ পজিটিভ নয়। ভাইরাস নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে যখন রক্তের সঙ্গে মিশবে এবং রোগের লক্ষণ প্রকাশ করবে তখনই এটা রোগ। রক্তের সঙ্গে মেশার আগে যদি আর-টি পিসিআর টেস্ট করা হয়, পজিটিভ আসবে। কিন্তু, রক্তের সঙ্গে মিশতে গেলেই মেমরি সেল অ্যান্টিবডি তৈরি করে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করবে। তার মানে হলো, করোনাভাইরাস আগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুনরায় আক্রান্ত করতে পারছে না। যদি না তার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।’
‘আমরা গত জুলাই থেকে যে কথা বলছিলাম, আমেরিকা বা ইউরোপ এখন সে কথা বলছে। করোনাভাইরাস বিষয়ে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল বলেই পৃথিবীতে প্রথম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ল্যাবে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য যে তা আলোর মুখ দেখল না। এই দুঃখ আমার সারাজীবন থেকে যাবে’, বলছিলেন ড. বিজন।
‘করোনাভাইরাস দ্বিতীয়বার আক্রান্ত করতে না পারলেও, তার বহন করা করোনাভাইরাস অন্যকে আক্রান্ত করবে’ উল্লেখ করে ড. বিজন বলেন, ‘আক্রান্ত হয়ে যিনি সুস্থ হয়েছেন তার জন্যেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। কারণ তার মাধ্যমে বহু মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। অর্থাৎ, সবার জন্য মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-