শাহাদাত হোসেন পরশ •
মাদক সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি গেল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৯ সদস্যের। এরই মধ্যে চাকরিবিধি অনুযায়ী সব ধরনের তদন্ত শেষ করে বরখাস্তের পর তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও আট পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া শিগগির ৫৯ পুলিশ সদস্যের চাকরি যাচ্ছে। একযোগে মাদকের ঘটনায় এত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে গতকাল এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা চাই পুলিশ মাদক চক্র থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসুক। পুলিশের যারা মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে ৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ডোপ টেস্টের মাধ্যমে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্য শনাক্ত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটা চলমান থাকবে। মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে সভা অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ডিএমপির সব উপপরিদর্শক ও পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এতে মাদকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আলোকপাত করেন পুলিশপ্রধান। এ ছাড়া পুলিশের কোনো সদস্য মাদক সেবন বা কারবারে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ডোপ টেস্টের মাধ্যমে ডিএমপির বিভিন্ন পদমর্যাদার ৬৮ পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া সদস্যরা প্রায় নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক কারবারেও জড়িয়ে গিয়েছিলেন। মাদক সংশ্নিষ্টতা শনাক্ত হওয়া পুলিশ সদস্যের মধ্যে এসআই সাতজন, সার্জেন্ট একজন, এএসআই পাঁচজন, নায়েক পাঁচজন ও কনস্টেবল ৫০ জন।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সদস্য হয়েও যারা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল বা অন্যান্য মাদক সেবনে যুক্ত ছিলেন, তাদের সেই পথ পরিহার করতে বলা হয়। স্বেচ্ছায় এই পথ থেকে দূরে সরে না গেলে বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে- এমন আভাসও দেওয়া হয়েছিল। বেশ কয়েক দফায় এমন বার্তা দেওয়ার পর মাদকাসক্ত সদস্যদের চিহ্নিত করতে ডোপ টেস্টের উদ্যোগ নেয় পুলিশ। এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্যের ডোপ টেস্ট করে ৬৮ জনকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
জানা গেছে, মাদকাসক্তদের শনাক্ত করতে ডিএমপি বিশেষ টিম গঠন করেছে।
প্রতিটি থানা, বিভিন্ন ইউনিট ও পুলিশ লাইন্সে এই ইউনিটের সদস্যরা কাজ করছেন। কাউকে মাদকাসক্ত সন্দেহ হলে তার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। এরপর তাকে ডোপ টেস্টের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। এমন অনেককে পাওয়া গেছে যারা কাজে অমনোযোগী বা সময়ের ব্যাপারে সচেতন নন- এমন সদস্যদের তালিকা তৈরি করে তাদের ডোপ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়।
জানা গেছে, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ এরই মধ্যে দু’দিন ডিএমপির বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রথম দিন সোমবার ডিএমপির সব কনস্টেবল, এএসআইদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল বৈঠক করেছেন এসআই ও পরিদর্শকদের সঙ্গে। এরপর বৈঠক করবেন এসপি ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের নিয়ে। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া দুটি বৈঠকে মাদকের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি রমনা থানার একজন এসআইকে মাদক সংশ্নিষ্টতার ঘটনায় গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই এসআই এক সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে ছিলেন। দীর্ঘদিন ওই এসআই একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ে মাদক ব্যবসা করে আসছিলেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পুলিশ জড়িত ছিলেন।
জানা গেছে, মাদকের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট হিসেবে এখন পর্যন্ত ডিএমপির যেসব সদস্য শনাক্ত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ পুলিশ লাইন্সে থাকতেন। তাদের বেশিরভাগ ইয়াবায় আসক্ত। কেউ কেউ ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে কারবারেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন।
এ ছাড়া চক্রের সঙ্গে যুক্ত আরও অন্তত ২৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তারা তেজগাঁও বিভাগের বিভিন্ন থানায় কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন এসআই মোশাররফ চৌধুরী, নবীন জাহান রানা, শাহরিয়ার, সুমন মিয়া কামাল হোসেন, এএসআই রানা ও কনস্টেবল তোফাজ্জল। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে কয়েকজন চিহ্নিত মাদক কারবারির ঘনিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া গেছে।
চলতি বছর ডিএমপিতে ডোপ টেস্ট শুরু হয়। প্রথম দফায় টেস্টে শনাক্ত হয়েছিলেন ২৬ পুলিশ সদস্য। দ্বিতীয় দফায় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮-এ। আর তৃতীয় দফায় এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ জনে। শনাক্ত হওয়া সদস্যদের মধ্যে পল্লবী, আদাবর, খিলগাঁও, উত্তরখান ও গেণ্ডারিয়া থানা ছাড়াও ডিবি, পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) কল্যাণ ও ফোর্স ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের সদস্য রয়েছেন। ডোপ টেস্টে শনাক্ত হওয়া কয়েকজন হলেন- সার্জেন্ট মুনতাসিম, এসআই মো. জাহাঙ্গীর, কনস্টেবল রাসেল, দীন ইসলাম, জুয়েল, আশরাফুল ও বারী।
সূত্র মতে, করোনাকালে মাদক কারবারিরা নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে। অনলাইনেও চলছে মাদক বেচাকেনা। মাদক কারবারিরা অভিনব সব কৌশল প্রয়োগ করে মাদক কেনাবেচা করছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সাজানো কফিনের ভেতরে ইয়াবা ও ফেনসিডিল পাচারের ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ বর্তমানে পাঁচটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো মাদক নির্মূল করা। পুলিশ নিজেরা মাদক থেকে দূরে থাকতে চায়। আবার মাদক কারবারিদেরও রুখে দিতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে নেওয়া হচ্ছে নানা কর্মসূচি।/সমকাল
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-