টেকনাফ পৌরসভার ইসলামাবাদে অফিস ভাড়া নেওয়ার লীজ চুক্তিনামা করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করে এক ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামবাদ এলাকার মৃত আবদুর রশিদের ছেলে হাজী কাদের হোসাইন বাদী হয়ে গত ৯ নভেম্বর কক্সবাজারের যুগ্ম জেলা জজ (২য়) এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক মাহমুদুল হাসানের আদালতে এ মামলাটি দায়ের করেছেন।
বাদীর আইনজীবী মুহাম্মদ আখতার উদ্দিন হেলালী জানিয়েছেন, আদালত মামলাটি আমলে বিবাদীদের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করার আদেশ দিয়েছেন।
মামলায় মূল বিবাদী করা হয়েছে ইউএনএইচসিআর এর কক্সবাজার সাব-অফিসের প্রধান ও ইউএনএইচসিআর এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি অফিস প্রধানকে।
এছাড়া মোকাবিলা বিবাদী করা হয়েছে সংস্থাটির স্থানীয় সরকারি তদারকি কর্তৃপক্ষ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, টেকনাফ পৌরসভার ইসলামাবাদস্থ হাজী কাদের হোসাইনের মালিকানাধীন ২ টি পাকা ভবন সহ সম্পূর্ণ জায়গাটি অফিসের জন্য ভাড়া নেওয়ার নিমিত্তে লীজ চুক্তিনামা করতে আগ্রহ প্রকাশ করে গত ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার সাব-অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেভিন জে অ্যালান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রেরণ করেন। ওই চিঠিতে ইউএনএইচসিআর এর পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয় যে, সরকার স্বীকৃত কোন প্রাইভেট প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান দিয়ে ভবন ২ টির ‘কাঠামোগত নিরাপত্তা নিরূপনকাজ’ এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এতে ভবন ২ টি প্রযুক্তিগতভাবে ব্যবহারের উপযোগী প্রমানিত হলে তৎসংলগ্ন জায়গাসহ ১ বছরের জন্য ভাড়ার চুক্তি সম্পাদন করবে। পরবর্তীতে মেয়াদ শেষে পুনরায় চুক্তি নবায়ন করা হবে।
এ ধরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে বাদী হাজী কাদের হোসাইনের সম্মতিতে মূল-বিবাদীদের নিযুক্ত পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ার ভবন ২টির পিলার ও ছাদ ফ্লোর খুদাই পূর্বক নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করেন।
এর প্রেক্ষিতে ভবন ২ টির ব্যবহার উপযোগিতা প্রমানিত হওয়ার পর ভাড়া নিতে চুড়ান্ত সম্মতি প্রকাশ করে গত ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর মূল-বিবাদী ইউএনএইচসিআর এর পক্ষে এলিজাবেথ প্যালেস্টার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাদী হাজী কাদের হোসাইনের নিকট প্রেরণ করা হয়। এতে বাদী গত ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর জি-মেইলের মাধ্যমে লীজ চুক্তি সম্পাদনের আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ১ নম্বর মূল-বিবাদীকে চুক্তির ব্যাপারে সরাসরি আলোচনা করার অনুরোধ করেন। এ নিয়ে এক ই-মেইল বার্তায় ইউএনএইচসিআর এর পক্ষে সারুন ( বৈদেশিক কর্মকর্তা ) গত ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর কক্সবাজার সাব-অফিসে এসে সরাসরি আলোচনা করতে বলেন। ওইদিনই বাদী ও ১ নম্বর বিবাদীদের মধ্যে লীজ চুক্তিনামার ব্যাপারে সরাসরি আলোচনা হয়।
এ নিয়ে মামলার বাদী হাজী কাদের হোসাইন বলেন, ভবন ২ টি ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর এর কক্সবাজার সাব-অফিসের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার প্রেক্ষিতে এবং বিবাদী জাতিসংঘের সংস্থা হওয়ার তাদের প্রেরিত ই-মেইল বার্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ভবন ২টিতে অবস্থানকারি ভাড়াটিয়াদের নোটিশ প্রদান করে খালি করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
“ এর আগে প্রতিমাসে একটি ভবন থেকে আড়াই লাখ এবং অন্যটি থেকে দেড় লাখ টাকা ভাড়া পেতাম। ভবন ২ টি সংলগ্ন জায়গায় স্থাপিত টমটম গ্যারেজ থেকে প্রতিমাসে ৬০ হাজার টাকা ভাড়া পেতাম। ”
বাদী বলেন, “ ইউএনএইচসিআর কর্তৃপক্ষের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী ভবন ২ টি নতুনভাবে সজ্জিতকরণ ও বিকল্প রাস্তা তৈরীর নিমিত্তে ভবনগুলো লাগোয়া জমির মালিকদের কাছ থেকে কিছু জায়গাও খরিদ করা হয়। এতে উক্ত জমির মূল্য সাব্যস্ত হয় ৪৮ লাখ টাকা। ওই জায়গা কিনতে তাকে ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। এছাড়া চলাচলের রাস্তা প্রশস্থকরণের জন্য ভবনগুলোর লাগোয়ো পুকুর ভরাট করতে বাদীকে ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে স্থাপিত টমটম গ্যারেজের স্থাপনাও। ”
হাজী কাদের হোসাইন অভিযোগ করে বলেন, মামলার মূল-বিবাদী ইউএনএইচসিআর কর্তৃপক্ষের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী সমস্ত কিছু সম্পাদন করার পর লীজ চুক্তিনামা সম্পাদনের জন্য অনুরোধ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সংস্থাটির বৈদেশিক কর্মকর্তা সারুন এক ই-মেইল বার্তায় জানান, লীজ চুক্তিনামা শ্রীঘ্রই সম্পাদন করা হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের কর্মকর্তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
“ কিন্তু এরপরও চুক্তিনামা সম্পাদন না করায় আমি ( কাদের হোসাইন ) ই-মেইল বার্তা পাঠিয়ে লীজের ব্যাপারে জানতে চাই। এর জবাবে ই-মেইলে ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা সারুন জানান যে, লীজ চুক্তির কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী সপ্তাহে চুক্তিনামা সম্পাদন করা হবে। ”
বাদী অভিযোগে আরো বলেন, “ এরপরও ইউএনএইচসিআর কর্তৃপক্ষ বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ না করায় সংস্থাটির কক্সবাজার সাব-অফিসে গিয়ে কথা বলা হয়। এতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, জাতিসংঘ থেকে অনুমোদিত হয়ে আসতে একটু সময় লাগতেছে বিধায় পরের মাসে জানাইবেন। পরের মাসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, সংস্থাটির বাজেট একটু কম। তাদের সিদ্ধান্ত মাসের শেষে জানানো হবে। এতে বাদী কিছুটা আশ্বস্ত হন। ”
কিন্তু এ নিয়ে সর্বশেষ চলতি বছরের গত ৩১ মার্চ ইউএনএইচসিআর এর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাজেট নাই জানিয়ে লীজ চুক্তিনামা সম্পাদন করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে অভিযোগ করেন হাজী কাদের হোসাইন।
এতে বাদী হাজী কাদের হোসাইন প্রায় ২ বছরে ভবন ২ টির প্রতিমাসের ৪ লাখ টাকার ভাড়া বাবদ আয়ের মোট ৩২ লাখ টাকা, প্রতিমাসের টমটম গ্যারেজ ভাড়া বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা, জমি ক্রয় বাবদ ৪৮ লাখ টাকা, জায়গা সংস্কারে পুকুর ভরাট বাবদ ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, গ্যারেজটির স্থাপনার মূল্য বাবদ ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, জমি কিনতে ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, ভবন ২ টি সংস্কার বাবদ ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং বাদীর সম্মানহানী জনিত বাবদ ১ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এর প্রেক্ষিতে ভূক্তভোগী হাজী কাদের হোসাইন ক্ষতিপূরণের টাকা দাবি ইউএনএইচসিআর এর সংশ্লিষ্টদের কাছে ই-মেইল প্রেরণ করেন। কিন্তু মামলার বিবাদী জাতিসংঘের সংস্থা হওয়ায় দাবির ব্যাপারে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে বাদী গত ২০১৯ সালের ৪ মার্চ ইউএনএইচসিআর এর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন।
কিন্তু ইউএনএইচসিআর কর্তৃপক্ষ লিগ্যাল নোটিশেরও কোন ধরণের জবাব না দেয়ায় ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার আবেদন জানিয়ে গত ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার বরাবরে মামলার বাদী হাজী কাদের হোসাইন একখানা দরখাস্ত করেন।
এর প্রেক্ষিতে সাবেক শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম গত ২০১৯ সালেও ২ জুন তারিখে আরআরআরসি/ডেমেজেড/২-১০/২০১৭-১০৪৪ স্মারক মূলে ইউএনএইচসিআর এর কক্সবাজার সাব-অফিসকে চুক্তিনামার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আবেদনকারির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এরপরও ইউএনএইচসিআর এর সংশ্লিষ্টরা কোন ধরণের ব্যবস্থা না নেওয়ায় আরআরআরসি বরাবরে গত ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হাজী কাদের হোসাইন ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার জন্য পুনরায় আবেদন করেন।
জাতিসংঘের অধিন্যস্ত সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক অফিস ভাড়ার জন্য লীজ চুক্তিনামা সম্পাদনের আশ্বাস দিয়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে কার্যক্রম চালানোর মধ্য দিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবার ব্যাপারে কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় অবশেষে গত ৯ নভেম্বর ভূক্তভোগী মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন হাজী কাদের হোসাইন।/সিবিটি
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-