রফিকুল ইসলাম •
ভয়ংকর মাদক ইয়াবার গন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। গত ৩ মাসে মাদক বিরোধী অভিযানে পুলিশের তৎপরতা নেই বলা চলে। র্যাব কিছুটা ভূমিকা রাখলেও তিন মাসের ব্যবধানে মাদক বিরোধী অভিযানে বিজিবি অনেকটা উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।
বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) একদিনে বিজিবি সীমান্ত এলাকা থেকে ৩ লক্ষ পিস ইয়াবাসহ ৬ জনকে আটক করেছে।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ রোডে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা মেজর সিনহা হত্যার ঘটনা ঘটে। কার্যত এরপর থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা যোগানের প্রধান মোকাম উখিয়া ও টেকনাফে মাদক বিরোধী অভিযান অনেকটা থমকে আছে। এ সুযোগে পালিয়ে থাকা বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা স্ব মূর্তিতে এলাকায় ফিরে এসে প্রকাশ্যে ফের এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কব্জায় নিয়েছে।
পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইয়াবা ব্যবসায়ী চক্রটি বহাল তবিয়তে রয়েছে। তারাই মূলত ইয়াবার বিস্তার করেছে সারাদেশে। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন রোহিঙ্গা ইয়াবা ও অস্ত্রসহ প্রশাসনের কাছে ধরা পড়ছে। উখিয়া-টেকনাফের বিশাল পাহাড়ী এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ায় সহজেই ধরা পড়েনা ইয়াবা মজুতকারী ও ব্যবসায়ীরা।
তবে কিছু পাচারকারী ও ব্যবসায়ী আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও অধরায় রয়ে গেছে রাঘববোয়ালরা। একারনে বন্ধ হচ্ছেনা ইয়াবা ব্যবসা এমনটা জানিয়েছেন সচেতনমহল।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ সেনা নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার আগে সেখানে রোহিঙ্গাদের অনেকেই ছিলেন ‘ইয়াবা ডন’।
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার পর কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তাদের সেই সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।
৩৪টি ক্যাম্পে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির চিহ্নিত আখড়া আছে পাঁচ শতাধিক। শরণার্থী ক্যাম্পের বাইরেও রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহন করছে।
দুই দেশের একাধিক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এদের নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে।উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চিহ্নিত সিন্ডিকেট গুলো ও তাদের আশ্রয়দাতা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। তাদের কারনে ইয়াবার আগ্রাসন প্রতিটি ঘরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। নষ্ট হয়ে পড়ছে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি শৃংখলা।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী জানান, মিয়ানমার থেকে অধিকাংশ ইয়াবা আনা হয়ে বাকীতে। বাংলাদেশ আনার পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা না পড়লে সেগুলো বিক্রি করে নগদ ও হুন্ডির মাধ্যমে বিক্রিত অর্থ মিয়ানমারে সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছানো হয়। ইয়াবা ব্যবসায় যারা বিনিয়োগ করে, ইয়াবা কারবারীদের আশ্রয় দেয় তাদের অধিকাংশ বিভিন্ন সংস্থার কাছে অনেকটা চিহ্নিত বলে জানা যায়।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহতের পর পুরো কক্সবাজার জেলায় পুলিশ মাদক বিরোধী অভিযান থেকে নিজেদের অনেকটা গুটিয়ে নেন। কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে গতি সেপ্টেম্বরে পুরো জেলার সবধরনের পুলিশের গণবদলি করা হয়। কক্সবাজার জেলা পুলিশের সবাইকে চট্টগ্রাম ব্যতীত দেশের বিভিন্ন রেঞ্জে বদলী করা হয়। চট্টগ্রাম রেঞ্জের বাইর থেকে কক্সবাজারে নিযুক্ত করা হয় সব শাখার পুলিশ।
বিভিন্ন রেঞ্জ ও বিভাগ থেকে আসা পুলিশ সদস্যরা এ অঞ্চলে একেবারে নতুন। তারা এখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতি, ভাষা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। গণবদলীর প্রায় দেড় দুই মাস পার হতে চললেও এখনও তারা এলাকা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারছেন না। অনেক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী,পলাতক অপরাধী পুলিশের সামনে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে। উখিয়া থানার ওসি মনজুর মোরশেদ বলেন,কে মাদক কারবারি, করে অপরাধী আমরা এখনও চিনি না। এখনও এলাকা সম্পর্কে জানি না। তবে পুলিশ বদলালেও কাজ কর্ম পুরনো বলে তিনি জানান।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ইয়াবার বিস্তারে কিশোর ও যুব সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ইয়াবার আগ্রাসন এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে, পাড়া -গ্রামে, অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাপক আকারে রোহিঙ্গা আশ্রয় দেয়ার পর থেকে ইয়াবার পাচার, ব্যবসা,সেবন, বেচাকেনা বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও আমরা ইয়াবা থেকে মুক্তি চাই বলে তিনি জানান।
বিজিবি কক্সবাজার- ৩৪ ব্যাটলিয়ান এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে সম্প্রতি ইয়াবা পাচার বেড়েছে। সীমান্তে মাদক পাচার, ব্যবসাসহ সব ধরনের বেআইনী তৎপরতা রোধে বিজিবি সদস্যরা কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলে তিনি জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় মাদক বিরোধী কঠোর অভিযান অব্যাহত থাকবে। গত আগষ্ট থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৪ বিজিবি বেশ উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করে। এসময়ে প্রায় ১৩ লক্ষ পিস ইয়াবা, ১২৬৯ ভরি স্বর্ণ, বন্দুক যুদ্ধে ১ জন্য নিহত, ৮৭ জনকে আটক ও ১৪০ টিকে মামলা করা হয়েছে বলে উক্ত বিজিবি পরিচালক জানান।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-