অনলাইন ডেস্ক •
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ বছরের এক কিশোরীর সঙ্গে কয়েক বছর আগে ইনস্টাগ্রামে পরিচয় হয়েছিল ঢাকার এক তরুণের। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। কৌশলে ঢাকার এই তরুণ মার্কিন ওই কিশোরীর নগ্ন ছবি দিতে চাপাচাপি করতো। প্রথমদিকে নিজের কিছু নগ্ন ছবি দেয় ওই কিশোরী। এক পর্যায়ে ওই কিশোরী বুঝতে পারে সে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের পাল্লায় পড়েছে। পরে ওই কিশোরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বিষয়টি জানায় ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কাছে।
সাইবার ক্রাইম বিভাগ দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস অনুসন্ধান চালিয়ে ভয়ঙ্কর এক চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের সন্ধান পায়। গত বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) এই চক্রের তিন সদস্য বোরহান উদ্দিন, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও অভি হোসেনকে গ্রেফতার করে। রোববার (১৮ অক্টোবর) তারা ৩ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, এই চক্রটি কৌশলে দেশি-বিদেশি শিশু ও কিশোরীদের ন্যুড ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে চাইল্ড পর্ন গ্রুপ ও ওয়েসবাইটগুলোতে সরবরাহ করতো। সারা দুনিয়ায় সাধারণত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে চাইল্ড পর্ন ট্রেড হয়ে থাকে। এই চক্রটি চাইল্ড পর্ন ট্রেড করে অর্থনৈতিকভাবে কী ধরনের সুবিধা পেয়েছে আমরা তাও খতিয়ে দেখছি।
যেভাবে এই চক্রের সন্ধান পাওয়া গেল?
ঢাকার সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন এক কিশোরী ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের কাছে একটি অভিযোগ করে। অভিযোগে ওই কিশোরী এক যুবক তার নগ্ন ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে বলে সাইবার ক্রাইম বিভাগকে জানায়। ওই কিশোরী সাইবার ক্রাইম বিভাগকে একটি আইপি নম্বর দেয়। সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা ওই আইপি নম্বরের সূত্র ধরে অনুসন্ধান শুরু করে।
সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা অনুসন্ধান চালিয়ে ওই আইপি নম্বরটির ব্যবহারকারীকে সনাক্ত করে। গত বৃহস্পতিবার রাতে উত্তর শাজাহানপুরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে আইপি নম্বর ব্যবহারকারী বোরহান নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রামপুরা থানাধীন রিয়াজবাগ থেকে আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে এবং পল্লবী এলাকা থেকে অভিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বোরহান একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। বাকি দুজন অপর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী।
যেভাবে চাইল্ড পর্ন ট্রেড করতো ওরা
সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বোরহানকে আটকের পর প্রথমে সে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির কথা অস্বীকার করে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে সবকিছু স্বীকার করতে বাধ্য হয়। বোরহানের ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে একটি ফোল্ডার উদ্ধার করা হয়, যেখানে ৪৫ দেশি-বিদেশি কিশোরীর নগ্ন ছবি পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিন হাজার ৩১৬টি ফাইল ছিল। এর মধ্যে মার্কিন ওই কিশোরীর নামেও একটি ফোল্ডার ছিল। এছাড়া বোরহানের কম্পিউটার ঘেঁটে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে বোরহান জানিয়েছে, সে মূলত ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ইনস্টাগ্রামে চাইল্ড পর্ন গ্রুপগুলোকে ‘শাটআউট’ নামে পরিচিত। এসব গ্রুপ থেকেই কিশোরীদের কিভাবে মোটিভেটেড করে নগ্ন ছবি সংগ্রহ করা যায়, সেসব কৌশল শিখেছে। পরে এই কৌশল প্রয়োগ করে কিশোরীদের নগ্ন ছবি সংগ্রহ করে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপগুলোতে আপলোড করতো।
সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বোরহানের আয়ত্তে থাকা অবস্থায় তার ছয়টি ফেক ইনস্টাগ্রাম আইডি উদ্ধার করেছেন তারা। এছাড়া একাধিক ফেক মেইল আইডিও উদ্ধার করা হয়েছে। ইনস্টাগ্রামের ফেক আইডি বানিয়ে নিজেকে লেসবিয়ান নারী হিসেবে তুলে ধরে দেশ-বিদেশের কিশোরীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতো বোরহান। এক পর্যায়ে কিশোরীদের কাছ থেকে নগ্ন ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করতো সে। সেসব ভিডিও এবং ছবি আপলোড করা হতো পর্ন ওয়েব সাইট ও গ্রুপে।
সাইবার ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার হওয়া বোরহানের কাছ থেকে তারা এমন কিছু নথিপত্র উদ্ধার করেছেন, যেখানে কিভাবে অনলাইনে একজন কিশোরীকে নগ্ন ছবি সরবরাহ করতে প্রলুব্ধ করা হবে তার ১৩টি কৌশল উল্লেখ রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বোরহান এই কৌশলপত্র তাকে ইনস্টাগ্রামের একটি চাইল্ড পর্ন গ্রুপের এডমিন তাকে দিয়েছে বলে জানিয়েছে।
চাইল্ড পর্ন ট্রেড হয় কিভাবে?
কড়া নজরদারির মধ্যেও বিশ্বজুড়ে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রমরমা বাণিজ্য চলে আসছে। মূলত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেই শিশু পর্নোগ্রাফির এই বাণিজ্য চলে। শিশু বা কিশোরীদের নগ্ন ভিডিও বা ছবি আপলোড করা হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। চলে লাইভ স্ট্রিমিংও। পয়সা খরচ করে সেসব ওয়েবসাইটে ঢুকে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এসব ক্ষেত্রে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয় সাধারণত ক্রিপ্টোকারেন্সি বিট কয়েন। অনলাইনে ডলার পেমেন্ট করেও এসব ওয়েবসাইটে ঢোকা যায়।
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা বিভিন্ন দেশ থেকে দশ হাজারেরও বেশি অপরাধীকে সনাক্ত ও গ্রেফতার করেছে। ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় টিপু কিবরিয়াসহ চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। ওই চক্রটি সেসময় অন্তত পাঁচ শতাধিক শিশুর পর্ন ভিডিও তৈরি করে অর্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক চাইল্ড পর্ন চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিল।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) সহকারী অধ্যাপক তানভীর হাসান জোহা বলেন, চাইল্ড পর্ন ট্রেডটা হয় মূলত ডার্ক বা ডিপ ওয়েবে, পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড সার্ভিসের মাধ্যমে। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় সাইবার পেট্রোলিং বাড়ানোর কারণে পর্ন সাইটগুলো সারফেস ওয়েবে চলে না। সবগুলো ডিপ ওয়েবে চলে যাচ্ছে। ডার্ক নেটে ক্রিমিনালরা ই-কমার্স ব্যবহার করে। আমাদের এখানেও অনেক লোকজন ডার্ক নেটে চাইল্ড পর্ণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য আমাদের ডার্ক নেট মনিটরিং করা প্রয়োজন।
তানভীর হাসান জোহা বলেন, যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা চাইল্ড পর্নের জন্য কাদের কাছে ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করতো তাদের শনাক্ত করার জন্য অধিকতর তদন্ত করা দরকার। এগুলোর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিয়ে চক্রের সকল সদস্যদের খুঁজে বের করা উচিত।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-