রফিকুল ইসলাম •
স্হানীয়রা রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় ক্রমান্বয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পসংলগ্ন মধুরছড়া এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান, লম্বাশিয়ার আলি হোসেন, বালুখালীর সেলিম জাহাঙ্গীর, রেদোয়ান, থাইংখালীর জামতলীর সাহাব উদ্দিনসহ অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তিন বছর ধরে ক্যাম্পের আশপাশে কোন ধরনের চাষাবাদ, সবজি খেত, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন পালন করতে পারছি না। তারা চর্তুদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে প্রতি মূহুর্ত চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয়ে। প্রায় সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে মারামারি, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, খুনের মতো ঘটনা ঘটায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে চরম উৎকন্ঠিত থাকতে হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশী-বিদেশী এনজিও-র কার্যক্রমের ওপর কঠোরভাবে নজরদারীর ও নিয়ন্ত্রণ না আনা পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সহজে সমাধান হবে না বলে তারা জানান।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী স্হানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সেবার নামে মোটা অংকের বেতন, ভাতা, বিভিন্ন ঠিকাদারী ও সাপ্লাই কাজের কমিশন বাণিজ্য, দিনের মধ্যভাগে ক্যাম্পে এসে ঘন্টা দুয়েক থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোটি টাকার বিলাসী গাড়িতে চড়ে বিকালে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার ও ইনানীর সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ শেষে রাতে কক্সবাজারের তারকা হোটেল গুলোতে আমোদ প্রমোদ করার মহা সুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করতে চায়! অথচ সরকারী অর্থায়নে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ভাসান চরে ওরা নিজেরাও যাবেনা এবং রোহিঙ্গাদেরও যেতে দেবে না। তবে আমাদের একমাত্র দাবী যেকোনভাবে রোহিঙ্গাদের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে আরও চরম ক্ষতি বা গভীর খাদের কিনারা থেকে উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ মানুষদের রক্ষা করা হউক।
ক্যাম্পগুলোর সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা সর্বস্ব হারিয়ে চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে খুব কঠিন মূহুর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু একশ্রেণীর রোহিঙ্গা যারা নিজ দেশ ও জন্মভূমি আরাকানে কোনদিন ভাল কাপড় পড়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পারেনি, যেখানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা অর্জন, চিকিৎসা গ্রহণ, চলাফেরার কোন স্বাধীনতা ছিল না।
সেই মগের মুল্লুক থেকে পালিয়ে এসে ৩ বছরের মধ্যে সবকিছু বেমালুম ভুলে আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের ভূমিতে সবকিছুর অবাধ সুবিধা পেয়ে রোহিঙ্গারা একেকজন বীর পালোয়ান হয়ে গেছে। নিজ দেশের ঘরে ভাল একটা দা,খুন্তি রাখতে পর্যন্ত পারেনি, আরও এখানে অনেকে বেশ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গাদের জুলুম নির্যাতন করছে। তাদের মতে এসব কি বাংলাদেশ সরকার জানে না বা দেখে না! তারা জানায়, এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা পারলে এখনই আরাকানে ফেরত যেতে চায়। কিন্তু যাওয়ার রাস্তা বন্ধ।
অনেকে ক্যাম্পের এসব অত্যাচার থেকে বাঁচতে গোপনে আরাকান চলে গেছে। তবে সেখানে মিয়ানমার নাকি রোহিঙ্গাদের আর গ্রহণ করছে না। তাদের মতে, শুনেছি ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে, এতে সরকার একটু বুঝিয়ে বললে অনেক রোহিঙ্গা যেতে রাজী রয়েছে, কিন্তু অনেকে বলেছে বর্ষাকালে ভাসানচর নাকি ডুবে যায়। এদিকে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু সেখানে তাদের না পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে চাপ আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
গতকাল (১৮ অক্টোবর) রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারতের নবনিযুক্ত হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না পাঠানোর জন্য ইউএনএইচসিআর-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে চাপ রয়েছে। তবে সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা সেখানে গেলে আরো ভালো থাকবেন।
কি সুবিধা ভাসানচরেঃ
থাকার জন্য পাঁকা দালানঘর; ঘর আলোকিত করতে সৌরবিদ্যুৎ। চুলা জ্বালাতে বায়োগ্যাস। আরো আছে আধুনিক বর্জ্য ব্যস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও।
সব মিলিয়ে জীবন-ধারনের আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচর।
মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেঁগে ওঠা এক চর। চরের বুক জড়ে গাঢ় সবুজের মাঝে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে লাল ও সাদা রঙের দালানগুলো। যার আঙিনা জুড়ে এখন নিরব অপেক্ষা। জানালায় নতুন সূর্যের উকিঝুঁকি।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এই ঘরবাড়ি। এর জন্য প্রকল্পটিতে খরচ হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
একরুমে চারজনের থাকার মতো দোতলা বেড। এমন ১৬টি রুম, নারী-পুরুষের জন্য আলাদা গোসলখানা, টয়লেট ও রান্নাঘর নিয়ে বানানো হয়েছে একেকটি বাড়ি। আর এমন ১২ টি বাড়ি নিয়ে একেকটি পাড়া বা ক্লাস্টার। পুরো প্রকল্পে মোট ১২০ টি ক্লাস্টার। প্রতিটি ক্লাস্টারে একটি করে চারতলা সাইক্লোন সেন্টার। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যেতে পাঁকা রাস্তাঘাট। রাস্তার পাশেই চোখে পড়ছে অত্যাধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেম এবং সারি সারি সৌর বিদ্যুতের খুঁটি।
দুইটি চারতলা ভবন রাখা হয়েছে ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের জন্য। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় রাখা হয়েছে দুইটি চার তলা স্কুল। তিনটি চারতলা মসজিদ, দুইটি এতিমখানা ও একটি ডে-কেয়ার সেন্টার। এক লক্ষ রোহিঙ্গার তিন মাসের খাদ্য মজুদ রাখা যাবে এখানে তৈরি চারটি ওয়্যার হাউজে। একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভবন তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের অফিস ও বাসস্থানের জন্য। ভিআইপি দর্শনার্থীদের জন্য বানানো হয়েছে একটি নান্দনিক ডুপ্লেক্স ভবন।
প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ১৩ হাজার একর আয়োতনের এই বিশাল চরের মাত্র ৭০০ এক জমির চারপাশে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের উপর প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে। আরো ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারনের জন্য রাখা হয়েছে যেখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকেও স্থানান্তর করা সম্ভব। কক্সবাজারের পাহাড়কে একটু স্বস্তি দিতে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরুর উপরই নির্ভর করছে এই প্রকল্পের সাফল্য।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-