জাগরণ •
মানবতার নৌকা ভাসানচরে যায়
• ভাসানচরের আবাসন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি
• শরণার্থী ক্যাম্পে সক্রিয় রোহিঙ্গাদের অপরাধ চক্র
• রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মহলের নিরবতা
• হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে সেনা নির্যাতনের মিথ্যাচার
• সীমান্তে মিয়ানমারের ধৃষ্টতা ও চুক্তি বাস্তবায়নে অনীহা
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র। মাদক ও মানবপাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এসব চক্রের সক্রিয়তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বাড়ছে সংঘাত। যার জেরে সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে অপরাধপ্রবণতা। তা ছাড়া বিগত তিন বছরে শরণার্থী শিবিরগুলোয় বেড়েছে জনসংখ্যা। যার প্রেক্ষিতে মূল ভূখণ্ডে বসবাসরত নিজ জনগণের স্বার্থরক্ষা ও রোহিঙ্গাদের স্থানসংকুলানে ভাসানচরে একটি সুপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ সরকার। আজ অবধি বিশ্বে যার নজির নেই। অথচ অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা মহল থেকে। যার মধ্যে সর্বশেষটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট ওয়াচের।
মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর ক্ষমতাসীন সু চি সরকারের মদদপুষ্ট সামরিক জান্তার নিধনযজ্ঞ ও বর্বর নির্যাতনের একপর্যায়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে। যার প্রেক্ষিতে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোয় ঠাঁই দেয় বাংলাদেশ সরকার। কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা বা আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলেও মানবিক দিক বিবেচনায় নিপীড়িত এসব অসহায় রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এদেশের সরকার এবং জনগণ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশনের রিপোর্টে এই রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রবিহীন সম্প্রদায় বলে বর্ণনা করে- রোহিঙ্গাদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিল ওই কমিশন।
একটি নব্য উন্নয়নশীল, ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে এখনো যেখানে নিজেদের সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে নিরন্তর লড়াই করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, সেখানে এই অতিরিক্ত মানুষের নিরাপত্তা প্রদান ও তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের যে বিশাল কার্যক্রমটি এখন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পরিচালনা করে আসছে সরকার। এই মানবিক তৎপরতা রীতিমতো বিস্মিত করেছে গোটা বিশ্বকে।
পক্ষান্তরে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডে সামরিক জান্তার প্রতি নির্লিপ্ত সমর্থন প্রদান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের হীনমানসিকতা প্রদর্শনে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী বর্মী নেত্রী অং সান সু চি। জাতিসংঘের বিশেষ তদন্ত কমিটি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক আদালতের অনুসন্ধানের প্রতিটি পর্যায়ে এই মানবতাবিবর্জিত রোহিঙ্গা নিধনে প্রমাণিত হয় সু চি সরকার ও তার স্বৈরাচারী অপশক্তির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ততোধিক শান্তিপূর্ণ আহ্বানের পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো প্রকার সক্রিয়তা দেখায়নি মিয়ানমার। অথচ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা তুলতেই প্রতিবার হাহাকার তুলে তা বাধাগ্রস্ত করেছে বার্মিজ এজেন্ট- একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এই মানবতার কাণ্ডারিরা রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রত্যাবাসনের দাবি নিয়ে সু চি সরকারের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস জোটাতে পারেনি আজও। বরং সেক্ষেত্রে তারা নতশিরে নীরব থেকেছে অনুগত ভৃত্যের মতো। যা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গা সংকট শুরুতে বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব সংস্থা আন্তর্জাতিক অনুদান ভোগের লক্ষ্যে মানবতার ঝাণ্ডা হাতে ছুটে এসেছিল, তাদের একটি পক্ষের স্বার্থসিদ্ধি হতেই মানবতার ফানুস মিলিয়ে গেছে বাতাসে। আরেকটি পক্ষ মিয়ানমার সরকারের এজেন্ট হিসেবে হাহাকার তুলে বাধাগ্রস্ত করতে সচেষ্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের যে বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের সরকার কাঁধে তুলে নিয়েছে, তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহল। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সীমান্তে সেনাসমাগম ও সমরাস্ত্র স্থাপনাসহ একাধিক ধৃষ্টতা দেখিয়েছে মিয়ানমার। শুধু তাই নয়, এই ইস্যুতে বিশ্ববাসীর নীরবতা এবং বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা বিষয়ে মিথ্যা প্রচারণা লজ্জাকর। বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারপ্রধান যেখানে সারাবিশ্বের বুকে মানবতা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শ হিসেবে ব্যাপক সম্মান অর্জন করেছে; কতিপয় সংগঠন ও সংস্থা সেই বাংলাদেশকেই মানবতাবাদের দীক্ষা প্রদানের হাস্যকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটু গভীরে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, তাদের উদ্দেশ্য মূলত সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো। আর এক্ষেত্রে যে তারা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পরোক্ষ নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা সুস্পষ্ট। দাবি করা হচ্ছে, ভাসানচরে নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছে রোহিঙ্গারা।
পক্ষান্তরে শান্তি প্রিয় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে ভিন্ন কথা। যেখানে নেই কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার সুর। শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসকারী প্রবীণ রোহিঙ্গা নাগরিক আব্দুল করিম বলেন, গত দুই সপ্তাহে শুধু কিছু সন্ত্রাসী নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করার জন্য ৮টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমরা এসব সন্ত্রাসীকে সমর্থন করি না। তাই আমরা নিরাপদ থাকার জন্য ভাসানচরে যেতে চাই।
মিয়নারঘোনা ক্যাম্পে বসবাসকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানে প্রাণের ভয় নিয়ে থাকার চেয়ে ভাসানচরে গিয়ে নিরাপদভাবে বসবাস করলে অনেক ভালো হবে।
জামতলি ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা আবুল কাশেম, ফরিদুল আলম, করিমা বেগম, রহিমা খাতুন ও মাবিয়া বেগম বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে ঘুমাতে পারছি না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে চলে গেছে প্রাণ বাঁচাতে। এভাবে কষ্ট করে এখানে থাকার চেয়ে আমরা ভাসানচরে চলে যেতে চাই।
এ ক্ষেত্রে হিউম্যান রাইট ওয়াচ সংস্থাটি এতটাই মরিয়া যে, শেষ পর্যন্ত যে স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল, তাদের ওপর বাংলাদেশ সেনাদের নির্যাতন চালনোর বীভৎস মিথ্যাচার রটিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতেও পিছ পা হয়নি তারা। তবে তাদের এই অভিযোগের কোনো সত্যতাই পাওয়া যায় না। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে যে দেশের সর্বোচ্চসংখ্যক সেনা-পুলিশ সদস্যরা, সেই দেশের সেনাসদস্যরা নিজ ভূখণ্ডে রোহিঙ্গা নির্যাতন করছে; সংস্থাটির এই হাস্যকর মিথ্যাচার নিঃসন্দেহে গোটা বিশ্বের সব মানবাধিকার সংস্থার নৈতিকতার চরম অবমাননা।
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। দেশের বিশেষজ্ঞ মহলের জিজ্ঞাসা, যখন কিনা শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সক্রিয় হয়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত সংঘাত বাড়ছে, ঠিক সেই সময় তাদের বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে যে কোনো মূল্যে ধরে রাখার এই মরিয়া প্রচেষ্টা- সুপরিকল্পিত কোনো নাশকতার নীলনকশা বাস্তবায়নের অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে না তো? তা না হলে চলমান অস্থিতিশীলতা রোধে যেখানে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর যৌক্তিক সমাধানের আদর্শ পথ হিসেবে সমর্থন পাওয়ার কথা, সেখানে সংস্থাটির এমন উল্টোপথে হাঁটা কেন? ভাসানচর থেকে দেশের মূল ভূখণ্ডে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব বলেই কি? সেক্ষেত্রে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি হলেই- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সর্বোচ্চ স্বার্থরক্ষায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরই শুধু নয়, জলে ভাসিয়ে দিলেও তা শতভাগ ন্যায্য বলেই বিবেচিত হবে। কারণ, অবশ্যই রোহিঙ্গাদের স্বার্থ দেশের মানুষের স্বার্থের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করবে না সরকার। সেক্ষেত্রে সত্যিই যদি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চায় সংস্থাটি, তাদের উচিত বাংলাদেশ নয় বরং মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
সবিশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভাসানচরের মানবিক অভয়ারণ্য। যা কাল্পনিকতায় বিবেচনা করা অপ্রাসঙ্গিক। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে মানবতাবাদী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে যে দুটি নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত রবে তাদের একজন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে মানবিক আশ্রয় প্রদানকারী তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আর সন্দেহাতীতভাবেই অপর নামটি বর্তমান বাংলাদেশের সরকারপ্রধান, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বিশ্বমানবতার বিশ্ববন্ধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেই শুভাগত সত্যের সার্থকতা, ভাসানচরের অভয়ারণ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নতুন করে বাঁচার স্পৃহা অর্জন এবং সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই প্রতীয়মান হবে। বিশ্বমানবতা অকুণ্ঠচিত্তে বলবে, ‘মানবতার নৌকা ভাসানচরে যায়
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-