কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের দু’পক্ষের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘাত বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়টিকে এখনই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে এটি বিস্তৃত হয়ে এ অঞ্চলের জন্যই বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর জরুরি। ভাসানচরের উন্নত পরিবেশে সাধারণ রোহিঙ্গারাও নিরাপদে থাকতে পারবে। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার উদ্বেগও কমবে।
সমকালের সঙ্গে আলাপে এ মত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্নেষক, কূটনীতিক ও শরণার্থী সংকটবিষয়ক গবেষকরা। তারা বলেন, সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে দ্রুতই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ শুরু করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার সমকালকে জানান, প্রায় এক বছর আগে তিনি নিজের আগ্রহ থেকেই ভাসানচর পরিদর্শন করে এসেছেন। তার সঙ্গে কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন। ভাসানচরে তারা অত্যন্ত আধুনিক ও নিরাপদ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ দেখেছেন। যেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর সম্ভব। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ বসবাস, উন্নত পয়ঃনিস্কাশন, সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা এবং জীবিকারও সুযোগ রয়েছে। কক্সবাজারে ক্যাম্পে বরং রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে কষ্টকর জীবনযাপন করছে। এ কারণে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা উচিত বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, ভাসানচরে সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাধা এসেছে একাধিক সুবিধাভোগী পক্ষের কাছ থেকে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরেই এই সুবিধাভোগী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একদল সুবিধাভোগী আছে, যারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, নারী পাচারের মতো কর্মকাণ্ড করছে। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ক্যাম্পের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যবসা চলছে বলে নানাভাবে তথ্য এসেছে। এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে, তার প্রমাণ ক্যাম্পের ভেতরে ধারাবাহিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান নিয়েই সংঘর্ষ হচ্ছে বলে খবর আসছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কক্সবাজারে ক্যাম্পের ভেতরে রাতে পুলিশ পর্যন্ত ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। রাতে ক্যাম্পের ভেতরে কী হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। এ অবস্থা কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্তব্যরত প্রশাসন, স্বাস্থ্যসেবাদাতা, অন্যান্য মানবিক সেবাদানকারীদের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। পাশাপাশি এটা বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ব্যাপারেও যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ অবস্থা চলতে পারে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়। এটাও এখন স্পষ্ট যে, কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।
মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, দ্বিতীয় আরও একটা সুবিধাভোগী অংশ হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে যারা রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করছেন। তারা আসলে কাজ করছেন নিজেদের জন্য, নিজেদের সুবিধার জন্য। তাদের সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গারা কিছু সহায়তা পাচ্ছে। এই সুবিধাভোগী অংশ কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেল, নিজেদের বিনোদনসহ যে সুবিধা পান, সেটা ভাসানচরে পাবেন না বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরে বিরোধিতা করছেন। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত, রোহিঙ্গাদের আরও ভালোভাবে বসবাসের বিষয়টি আগে নিশ্চিত করাটাই মানবিক দিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। অসহায় মানুষের জন্য যারা কাজ করেন, তাদের বিবেচনায় নিজেদের ফাইভ স্টার সুবিধার কথাটি কখনই মাথায় থাকা উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক দেশের সরকারকেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতার কথা সবার আগে বিবেচনা করতে হয়। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত সেই বিবেচনা থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে জরুরি গুরুত্ব দিয়ে স্থানান্তর করা এবং ভাসানচরের মতো আরও এ ধরনের ক্যাম্প তৈরি করে সেগুলোতেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া।
ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ এ বিষয়ে বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে নিলেই সংকটের সমাধান হবে না। সংকটের প্রকৃত সমাধান রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফেরত নেওয়া। এ কারণে প্রত্যাবাসনের জন্যই আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য কক্সবাজারের চেয়ে অনেক উন্নত ও আধুনিক সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের যতজনকে সম্ভব ভাসানচরে স্থানান্তর যুক্তিযুক্ত।
তিনি বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে হানাহানি ও সহিংসতা চলছে, তার পেছনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মদদ থাকতে পারে। কারণ রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা চলে আসার পর সেখানের ফাঁকা জায়গা বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। দৃশ্যত আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। অনেক রাষ্ট্রই মিয়ানমারের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক সীমিত করছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতাদের একটি অংশকে ব্যবহার করে সেখানে সংঘাত ও সহিংস ঘটনা ঘটানোর জন্য এ কাজটি করতে পারে। যাতে সংকট সমাধানের মূল প্রচেষ্টা ব্যাহত হয় এবং প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হয়।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বর্তমান পরিস্থিতিকে খাটো করে দেখা যাবে না। অবশ্যই জরুরি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, কারণ এই সংঘাত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, একই সঙ্গে এ অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবাইকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরুর জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। এটি এক পর্যায়ে নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এ আশঙ্কার কথা তিনি আরও অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। প্রায় দেড় বছর আগে যখন এ প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি আলোচনা তোলেন, তখন অনেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না, এমন আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এখন দেখা যাচ্ছে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রকৃত অর্থে নিয়ন্ত্রণে নেই। সেখানে নানা ধরনের গুরুতর অপরাধকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। এটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, দেখা যাচ্ছে যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নানা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আছে। এ কারণেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আরও আগে থেকে শুরু হলেও তা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ ছিল না। এখন তো এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাই সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে ভাসানচরে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।
তিনি বলেন, সেখানে অনেক টাকা খরচ করে রোহিঙ্গাদের জন্য আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যারা নিয়মিত আয়ের পথ তৈরি করেছে, তারা কখনই চাইবে না রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাক। এ কারণে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের কোথায় রাখা হবে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। যারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে, তাদের সেই সহায়তার কাজটিই নিষ্ঠার সঙ্গে করা উচিত। রোহিঙ্গাদের কোথায় রাখা হবে, তা নিয়ে তাদের উপযাচকের ভূমিকা প্রত্যাশিত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আসলে কক্সবাজারে যে রোহিঙ্গারা আছে তারা সেখান থেকে খুব সহজেই নাফ নদীর ওপারে তাদের দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। ভাসানচরে গেলে এই যোগাযোগ কঠিন হয়ে যাবে, এমন একটি ভাবনা উস্কে দিয়েই কিছু মানুষ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে চায়। কারণ তারা সেখানে বসবাসের জন্য ভালো বাসস্থান পাবে, জীবন ধারণের জন্য জীবিকা পাবে, আরও ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবে এবং সন্তানদের লেখাপড়ার নিশ্চয়তাও পাবে। অতএব তাদের ভাসানচরে যেতে না চাওয়ার কোনো কারণ নেই। সমস্যা হচ্ছে, কিছু রোহিঙ্গা নেতা এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত কিছু স্থানীয় ব্যক্তি নিজেদের অনেক সুবিধা, অবৈধ উপার্জনের পথ হাতছাড়া করতে চায় না। এ কারণে তারা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে বাধা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন সরকারকে কঠোর হতে হবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে হবে। কোনো একটি গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নিতে পারে না। এ জন্য এখন আর বিরোধিতাকে গুরুত্ব না দিয়ে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদেরকে তাদের দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনেই আরও কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-