'পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণ ও নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দাবিতে বিশাল মানববন্ধন

সেন্টমার্টিন নিয়ে হটকারি সিদ্ধান্ত মানা হবে না

শাহেদ মিজান •

সেন্টমার্টিনদ্বীপে পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণ ও নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে ট্যুর অপারেটরস্ এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক)। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা আজ রোববার (১১ অক্টোবর) দুুপুর ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক স্মারকলিপি দেন।

ট্যুর অপারেটরস্ এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ এর সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম-সম্পাদক এস কাজল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনের প্রধান অতিথি ছিলেন টুয়াকের প্রধান উপদেষ্টা মুফিজুর রহমান মুফিজ।

বক্তব্য রাখেন টুয়াকের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান এম.এ হাসিব বাদল, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস.এম কিবরিয়া, সিনিয়র সহ-সভাপতি আনোয়ার কামাল, সহ-সভাপতি হোসাইন আহামদ বাহাদুর, সাধারণ সম্পাদক আসাফ উদ্ দৌলা আশেক, সেন্টমার্টিন হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম জিহাদী।

মানববন্ধনের প্রধান অতিথি টুয়াকের প্রধান উপদেষ্টা মুফিজুর রহমান মুফিজ বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করার জন্য অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১২৫০জন পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে বিদেশী পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে না আসার পাশাপাশি দেশীয় পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে বিমুখ হবে। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমন ব্যবসা ক্ষতি হওয়ার সাথে সাথে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে উঠা কক্সবাজার পর্যটন ব্যবসাও ক্ষতি সাধিত হবে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে পর্যটক ভ্রমন সেবা প্রদানের মাধ্যমে দুইশতাধিক ট্যুর অপারেটর ও পাঁচ শতাধিক গাইড এবং লক্ষাধিক পর্যটকসেবি কর্মকর্তা-কর্মচারি তাদের কর্মসস্থান হারাবে।
তিনি আরো বলেন, কক্সবাজারের উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়ার জন্য এক চক্র এই ষড়যন্ত্র করছে। তারাই প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে এই হটকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কক্সবাজারের পর্যটনখাত থেকে আয় হওয়া বিপুল রাজস্ব দেশের জন্য বিশাল অবদান রাখছে। বাংলাদেশ যে উন্নয়নকের দিকে হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে কক্সবাজারের অবদান উল্লেখ্য।

টুয়াক সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য মন্ত্রণালয়ে বসে একটি চক্র এই হটকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বিশ্বের নন্দিত পর্যটন নগরীকে কক্সবাজারকে পিছিয়ে দিয়ে কুয়াকাটা ও সুন্দরবনকে প্রমোট করার অপচেষ্টা করছে। বিষয়টি বিবেচনা করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য সংসদ আশেক উল্লাহ রফিক আপনারা সেন্টমার্টিন নিয়ে এই হটকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলুন।

তিনি বলেন, পর্যটনকে ভালবেসে বাৎসরিক মাত্র ৫ মাস ব্যবসা করার ঝুঁিক নিয়ে উদ্যোগক্তাগণ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। এই হটকারি ও কক্সবাজারের পর্যটন ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে এই বিনিযোগকারীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। পাশাপশি কর্মরত তিন লক্ষাধিক মানুষ ব্যবসা ও কর্মসংস্থান হারাবে। মানুষ মারা এই সিদ্ধান্ত আমরা কখনো মেনে নেবো না। অচিরেই এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে। প্রয়োজনের প্রাণ দেবো।

সেন্টমার্টিনের পর্যটন সীমিত করা হলে স্থানীয় জনগণ পূর্বের অবস্থায় ফিরে গিয়ে সমুদ্র হতে মাছ আহরণ, প্রবাল উত্তোলন, প্রবাল পাথরকে নির্মাণ কাজে ব্যবহার, মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস, শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবে। এতে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক হুমকীর সম্মুখিন হবে বলেন টুয়াক সভাপতি।

মানববন্ধনে অংশ সেন্টমার্টিনের পর্যটন সংশ্লিষ্ট সাতটি সংগঠনের লোকজন অংশ নেন। এছাড়াও পর্যটন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক, ট্যুর অপারেটরসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট শত শত লোকজন অংশ নেন।

প্রধানমন্ত্রী কাছে দেয়া স্মারকলিপিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে সাতটি দাবির তুলে ধরেন টুয়াক। দাবিসমূহ হলো-

১। চলমান অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পর্যটকদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমনের সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

২। স্বদেশী পর্যটকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অর্ন্তভুক্ত না করা এবং কোন প্রকার সেবা/ভ্রমন চার্জ আরোপ করা না করা। শুধুমাত্র বিদেশী পর্যটকদের নিবন্ধনের আওতায় আনা ও বিদেশী পর্যটকদের ক্ষেত্রে সেবা/ভ্রমন চার্জ আরোপ করা যেতে পারে।

৩। টুয়াক কর্তৃক গৃহীত ‘প্লাস্টিক ফ্রি ইকো ট্যুরিজম, কক্সবাজার’ নামক প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়িত করার অনুমোদন ও সহায়তা প্রদান।

স্মারকলিপিতে পর্যটন ও পরিবেশের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে দায়িত্বশীল ইকো ট্যুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনদ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে ১২টি প্রস্তাবনাও তুলে ধরে টুয়াক। প্রস্তাবনা হলো-

১) সেন্টমার্টিনদ্বীপে পরিবেশ রক্ষার জন্য ক্ষতিকারক সকল ধরনের প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের ব্যবহার ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।

২) দ্বীপের ভাঙ্গনরোধে মূল ভূখন্ড থেকে ৫০০ মিটার দীর্ঘ আধুনিক জেটি তৈরির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা।

৩) পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ইকো হোটেল, মোটেল এবং হোম স্টে মডেল তৈরী ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা।

৪) দ্বীপে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এবং জেনারেটর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।

৫) দ্বীপের একটি অংশকে পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জীব বৈচিত্র্যের জন্য অভয়ারুণ্য ঘোষনা করা।

৬) পর্যটক এবং স্থানীয়দের ময়লা-আবর্জনা একটি নির্ধারিত স্থানে সংগ্রহ করে অপচনশীল আর্বজনাগুলোকে দেশের মূল ভূখন্ডে নিয়ে আসা এবং প্লাস্টিক ফ্রি সেন্টমার্টিন ঘোষনার প্রকল্প গ্রহণ করা।

৭) সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভাঙ্গনরোধে জিও ব্যাগের পরিবর্তে চারপাশে বেশি বেশি কেয়াবন তৈরি, নারিকেল গাছ ও ঝাউগাছের বেষ্টনী তৈরী করে বালিয়াড়ি রক্ষা করা।

৮) সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূগর্ভস্থ ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সেন্ট্রাল এসটিপি বাস্তবায়নের প্রকল্প গ্রহণ করা।

৯) দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে সমুদ্রের পানিকে শোধন করে ব্যবহার উপযোগী করার প্রকল্প গ্রহণ করা।

১০) প্রবাল প্রাচীরের সুরক্ষা এবং প্রবাল পাথরের স্তর বৃদ্ধিতে দেশি-বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।

১১) আন্ডারওয়াটার ন্যাচার সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ, সমুদ্র তলদেশের প্রবাল উত্তোলণ ও মৎস্য প্রজননে ব্যঘাত ঘটে এমন কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা।

১২) বøু ইকোনমিতে মেরিন ট্যুরিজম বিকশিত করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম মডেল হিসেবে গড়ে তোলা।

আরও খবর