⇨*আতংকে ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে শ’শ রোহিঙ্গা পরিবার।
⇨*এনজি কর্মীদের ক্যাম্প ছেড়ে আসতে বলা হচ্ছে।
⇨*অস্ত্রসহ আটক হয়েছে ১১ রোহিঙ্গা।
দীপন বিশ্বাস, কক্সবাজার •
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গত পাঁচদিনে এক নারীসহ ৮ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা। এছাড়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে শতাধিক ঝুপড়ি ঘর ও ৫০টি দোকান ভাঙচুর হয়েছে। সংঘর্ষের কারণে ইতোমধ্যে আতংকে সাধারণ ৫শ’ রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্প-১ থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য ক্যাম্পে ও আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট এনজিও সহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের দ্রুত ফেরত আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মকর্তাদের স্ব স্ব এনজিওর পক্ষ থেকে এই নির্দেশ দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর সকালে র্যাব অভিযান চালিয়ে ৯ জন রোহিঙ্গা ডাকাতকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি তারা চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। শিবির থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাটা তারের বেড়াও তারা মানছে না।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে আনাস ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত ০১ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। সকালে সমিরা আক্তার (৪১) নামের একজনকে মৃত উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহত সমিরা কুতুপালং ৩ নম্বর ক্যাম্পের এফ ব্লকের মৃত ছৈয়দ আলমের মেয়ে। গত ৪ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ভোর ৪টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের ২ ওয়েষ্ট এর ডি ৫ ব্লকের মৃত সৈয়দ আলমের ছেলে ইমাম শরীফ (৩২) ও ডি ২ ব্লকের মৃত ইউনুসের ছেলে শামসুল আলম (৪৫) নামে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
গত ৫ অক্টোবর রাত ১১ টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত আনাস ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষে মোহাম্মদ নাসিম (২৪) নামে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবক কুতুপালং ডি-৪, ২ ওয়েস্ট ক্যাম্পের মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে।
গত ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দু’গ্রুপের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়। এতে স্থানীয় ২জন সহ ৪ জন নিহত হয়েছেন।
স্থানীয়রা হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালীর বাসিন্দা নোহা গাড়ির চালক নরুল হুদা অপরজন হেলপার আবুল বশর। তাদের দু’জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।। নিহত অপর দুইজন শীর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মুন্নার ভাই। একজনের নাম গিয়াস উদ্দিন আরেকজনের নাম ফারুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এপিবিন সূত্রে ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৫শ’ রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্প-১ থেকে পালিয়েছে :
কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, আনাস গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৫’শ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দোকানপাট বন্ধ আছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।
কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরি ও লাঠির আঘাতে কমপক্ষে ১০০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও কুতুপালং এনজিওদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ডাকাত আটক :
কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান জানান, গত কয়েকদিন ধরে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলছিল। এতে গোলাগুলিতে বেশ ক’জন রোহিঙ্গাও মারা যায়। তিনি বলেন, অভিযান টের পেয়ে রোহিঙ্গা ডাকাতরা কুতুপালং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে র্যাব তাদেরকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে মঙ্গলবার সকাল তাদেরকে ধাওয়া করতে করতে টেকনাফের চাকমারকুল পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় তৈরি চারটি অস্ত্র, ২০ রাউন্ড ও কিছু কিরিচ উদ্ধার করা হয়। আটককৃত ৯ জনই রোহিঙ্গা ডাকাত। এছাড়া বুুুধবার সকালে আরও দুই যুবককে আটক করা হয়। এদের আইনি প্রক্রিয়া শেষে থানায় সোপর্দ করা হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এনজিও কর্মীদের সরিয়ে আনা হচ্ছে :
গত কয়েক’দিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট এনজিও সহ বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের সরিয়ে আনা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত সকল এনজিও কর্মকর্তাদের স্ব স্ব এনজিওর পক্ষ থেকে সরিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। এনজিও কর্মীরা ক্যাম্প থেকে ফেরত আসতে প্রয়োজনীয় গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। প্রত্যেক এনজিও কর্মীকে এই সংক্রান্ত বিশেষ জরুরী বার্তা দেয়া হয়েছে। বিশেষ বার্তা পাওয়ার পরপর সকল এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কক্সবাজারে ফেরত আসতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এদিকে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দুই বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
যেখানে রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকন্ড ও সহিংস আচরণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা জানান, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে রেজিস্ট্রার্ড এবং আনরেজিস্ট্রার্ড কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। সকালেই ঘটনাস্থলে পুলিশ টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-