রোহিঙ্গাদের অপরাধ-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে যত উদ্যোগ

বাংলা ট্রিবিউন ◑ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কবে হবে জানে না কেউ। উপরন্তু, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট নানা সংকট ও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। মাদক ও মানবপাচার, ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তাদেরকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা ও নজরদারিতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। পুলিশের নিয়মিত ইউনিটগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে নিরাপত্তায় কাজ করছেন।

শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করতে আর্মড পুলিশের (এপিবিএন) একটি ব্যাটালিয়ন সৃষ্টি করে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কক্সবাজার এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ভাষানচরে পাঠানোরও চেষ্টা চলছে।

স্বরাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমার নাগরিকের (রোহিঙ্গা) বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। এই হিসাব গত ২৮ মে (২০২০) পর্যন্ত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ জন রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থী এতিম শিশু রয়েছে ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। আশ্রয় প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু। প্রতিবছর অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে ৩৫ হাজারের বেশি নারী। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহার হচ্ছে। শুধুমাত্র নতুন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্যাম্পের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ করা হয়েছে।

দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী সেলের কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালির নতুন এলাকাকে ২২টি ক্যাম্পে বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উখিয়ার হাকিমপাড়া, জামতলী ও পুটিবুনিয়া এবং টেকনাফের কেরনতলী, উনছিপ্রাং, আলীখালী, লেদা, জাদিমুরা, নয়াপাড়া শালবন ও শামলাপুরকেও পৃথক পৃথক ক্যাম্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে সব মিলিয়ে ক্যাম্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪টি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, রোহিঙ্গাদের আইনি সহায়তাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকাগুলোতে একাধিক পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নিয়মিত পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও আর্মড পুলিশের একটি নতুন ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে। মাদক ও মানবপাচার, জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য ‘ইমারজেন্সি মাল্টি সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স’ নামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় আর্মড পুলিশের ১৪তম ব্যাটালিয়নকে সেখানে মোতায়েন করা হয়। এই ব্যাটালিয়নে সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা যেনো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য ওই এলাকায় তারকাঁটার বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে। স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যেকোনও ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ ও আইনি সহায়তার জন্য ‘কুইক রেসপন্স টিমে’র কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর কাজও চলছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৩৩৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ইমারজেন্সি মাল্টি সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স’ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৪ কোটি টাকা বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়ার কথা। বাকি টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার।

রোহিঙ্গা ক্রাইসিস ও জননিরাপত্তায় নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক ও আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর ছিদ্দীক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস নিরসনে কাজ করছে সরকারের অনেকগুলো বিভাগ। জননিরাপত্তায় রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে বড় কাজটি হচ্ছে সেখানে ক্যাম্পগুলোর চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ। বর্ষা ও করোনার কারণে কাজ কিছুটা ধীর গতিতে চললেও কাঁটাতারের বেড়ার কাজ ৪০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। আগামী শুকনো মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই এ কাজ শেষ করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে যে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নটি মোতায়েন করা হয়েছে, সেখানে এরইমধ্যে এক হাজার ৬০০ এর মতো সদস্য কাজ শুরু করেছেন। আরও সমপরিমাণ ফোর্স সেখানে যোগ দিতে যাবে শিগগিরই।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী সেলের প্রধান ও যুগ্ম সচিব শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে। আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য প্রায় সোয়া দুই লাখ শেল্টার (অস্থায়ী ঘর) নির্মাণ করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে খাদ্য, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও মানবিক সহায়তা। কোভিড মোকাবিলায়ও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ২৩২ জন ডাক্তার ও ২০৭৩ জন সেবাকর্মী ১১৬টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ২৮০ জন ডাক্তার ও নার্সকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’

আরও খবর