মাহমুদুল হাসান নয়ন ◑
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলামত থেকে পাওয়া গেছে বেশকিছু খণ্ডিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত।
এগুলোকে জোড়া লাগিয়ে নিখুঁত তদন্তের মাধ্যমে সিনহার বোনের করা মামলাটির সুরাহা করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। আর এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি তাৎক্ষণিক নাকি পরিকল্পিতভাবে হয়েছিল-সেটি উদ্ঘাটন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া টেকনাফ থানার সেই রাতের দুটি সিসিটিভি ফুটেজ না পাওয়ায় থানার প্রকৃত চিত্র এবং সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা বের করতেও কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে সমন্বিত খণ্ডিত চিত্রের (তথ্য-উপাত্ত) মাধ্যমেই হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে বলে আশাবাদী মামলার তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত আসতে থাকে। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে যাচাই-বাছাই করতে হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের।
প্রতিদিনই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করছেন। অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায় এবং নিরপরাধ কেউ যাতে জড়িয়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
সিনহা হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্তে এবং সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদানে ইতোমধ্যে র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন একাধিকবার কক্সবাজার গিয়েছেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, যদি বাস্তব চিত্রটা জানাতে চাই, সেটা হল- ৩১ তারিখ রাতে বাস্তবিক অর্থে কী ঘটেছিল তার খণ্ড খণ্ড চিত্র ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি।
যার ফলশ্রুতিতে ওই খণ্ডিত অংশগুলোকে ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি জোড়া লাগিয়ে একটি বাস্তব রূপ দাঁড় করানো তদন্তকারী কর্মকর্তার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তিনি আরও বলেন, অনাকাক্সিক্ষত এবং মর্মান্তিক এই ঘটনাটির বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরও বলেন, দু’দফায় আমরা অভিযুক্তদের রিমান্ডে এনেছি। এর অন্যতম প্রধান কারণ রিমান্ডে তারা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত আমরা তাদেরকে পুনরায় রিমান্ডে নিয়ে এসেছি। তারা যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তকারী কর্মকর্তা সেসব তথ্যকে সমন্বিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন।
তিনি বলেন, একটি ইতিবাচক অগ্রগতি ইতোমধ্যে হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মামলাটির সুরাহা করতে পারব।
হত্যার মোটিভ বা কোনো ক্লু জানতে পেরেছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূলত একটি প্রেক্ষাপট থাকে।
ওই প্রেক্ষাপট বা উদ্দেশ্য কি পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্তের ফল-সেটি তদন্তকারী কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করছেন। এই মুহূর্তে বলাটা সমীচীন হবে না তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল। তবে আমরা ঘটনাদৃষ্টে দু’রকম তথ্যই পাচ্ছি।
একরকম তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়ার, যা ইতোমধ্যে এজাহারে অভিযুক্তরা বর্ণনা করেছেন। আরেকটি তথ্যের খণ্ডিত অংশ, যেটি একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ বলে আমরা বিভিন্নভাবে তথ্যচিত্র পাচ্ছি।
এদিকে টেকনাফ থানা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ চুরি হওয়ার ঘটনায় মামলার তদন্তে অন্যান্য আলামত ব্যবহার করছে র্যাব। সেই রাতে টেকনাফ থানায় কী হয়েছিল এবং অভিযুক্তদের ভূমিকা কী ছিল, তা জানতেই তদন্তে বিকল্প চিন্তা করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। সে জন্য তারা বিভিন্ন আলামত ও সাক্ষীদের এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে র্যাব মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে থানা কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্তকারী কর্মকর্তা সিসিটিভি ফুটেজের জন্য আবেদন করেন। সেটি না পাওয়ায় আমরা আদালতের শরণাপন্ন হই।
আদালতের নির্দেশক্রমে যখন আমরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতে যাই সেখানে জানানো হয় দুটি ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার, সিসিটিভি ফুটেজ যেখানে রক্ষিত থাকে) এর মধ্যে একটি ইতোমধ্যে চুরি হয়েছে। অন্য যেটি আছে সেটিতে কারিগরি ত্রুটি আছে বলে আমাদেরকে জানানো হয়।
এই সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অন্যান্য যে ধরনের আলামত আছে, সাক্ষী আছে-সেসব বিষয়কে আমলে নিয়ে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
থানা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ চুরির বিষয়ে তিনি বলেন, একটি জিনিস কিন্তু আমাদেরকে মাথায় রাখা প্রয়োজন, থানা হচ্ছে গণমানুষের আস্থার একটি স্থল। যেখানেই কোনো ঘটনা ঘটুক না কেন, মানুষ কিন্তু সর্বপ্রথম পুলিশের কাছে এটি ‘অ্যাপ্রোচ’ করে।
থানা থেকে যে চুরি হয়েছে এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দেবেন বলে আশা করি।
সিনহা ও তার টিমের কাজের উদ্দেশ্য : সিনহা ও তার টিম কেন কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন এবং তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল, তা নিয়ে কাজ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পেতে সিনহা ও তার টিমের থেকে পাওয়া বিভিন্ন ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। যা থেকে প্রাপ্ত তথ্যই বলে দেবে সিনহা সেখানে কেন গিয়েছেন।
এ বিষয়ে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, মূলত একটি মামলার দুটি দিক থাকে। একটি হচ্ছে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা এবং আরেকটি হচ্ছে প্রেক্ষাপট। যেটিকে আমরা বলে থাকি, এটি কি পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিক।
যে বিষয়টির কথা আসছে, সেটি মূলত এই প্রেক্ষাপটের দিকেই ইঙ্গিত করে। সুতরাং যে ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কথা বলছেন, সেগুলো আমাদের হাতে এসেছে। এ ধরনের ডিভাইসগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার করার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের ‘জাস্ট গো’ নামের যে চ্যানেলটি আছে ওই চ্যানেলটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ধারণা পাব।
অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে মেজর (অব.) রাশেদ মো. সিনহা কেন অবস্থান করছিলেন-সেটি জানতে পারব। সুতরাং ফরেনসিক রিপোর্ট আসার পর আমরা বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করতে পারব।
র্যাব শুধু হত্যার ঘটনা তদন্ত করবে : ওসি প্রদীপ এবং তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে র্যাব তদন্ত করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রকৃতপক্ষে একটি কথা আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই- জীবিত সিনহা মো. রাশেদের চেয়ে মৃত সিনহা মো. রাশেদের প্রেক্ষাপটটা অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে।
সুতরাং ওসি এবং অন্য সংশ্লিষ্টদের আর্থিক যে বিষয় আসছে, এ বিষয়ে র্যাবের অবস্থান খুবই স্পস্ট- আমরা মূলত ৩১ তারিখ রাতে যে ঘটনাটি ঘটেছে এবং এর পরম্পরায় যে ধরনের বিষয় আসছে, সেগুলো আমলে নিয়ে আসব।
কারণ স্ত্রীর সম্পদসহ অন্যান্য বিষয় যেগুলো র্যাবের নজরে এসেছে সেগুলো আমাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। সংশ্লিষ্টরা এটি নিয়ে কাজ করবেন বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় বিস্তারিত জানতে ২১ আগস্ট তিন প্রধান আসামি- বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে ঘটনাস্থলে নেয়া হয়।
তারা পুরো ঘটনা র্যাবের কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার।
তখন তিনি বলেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নানাভাবে বিশ্লেষণ করে ঘটনা যাচাই করছেন।
এ ঘটনায় নির্দোষ কেউ যাতে জড়িয়ে না যায় বা কোনো দোষী ব্যক্তি যেন ছাড় না পায়, সব বিবেচনা করেই স্পর্শকাতর মামলাটির তদন্ত চলছে। কোনো সত্য যাতে গোপন না থাকে, সে জন্য প্রতি সেকেন্ড বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।/যুগান্তর
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-