১৪ মাসে মিয়ানমারে পাচার ৯শ কোটি টাকা

মিয়ানমার থেকে ইয়াবা কিনতে শত শত কোটি টাকা পাচার করছে মাদক কারবারিরা। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত ১৪ মাসে ৯০০ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে মিয়ানমারে। বিপুল এই টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে কারবারিরা নেয় নানা কৌশল। হুন্ডির পাশাপাশি বড় কারবারিরা বিদেশে গিয়েও লেনদেন মেটাচ্ছে। আর দেশ সয়লাব হচ্ছে মারাত্মক মাদক ইয়াবায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে চাহিদা কমাতে না পারলে এই সংকট থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।

কয়েক বছর ধরে এই মারণ মাদকের বিস্তার ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে আসছে। অবশ্য দেশে প্রবেশ করা এই মাদকের কত শতাংশ ধরা পড়ে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি কোনো বাহিনীর কাছে। তবে এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে আসা মাদকের ১০ শতাংশ ধরা সম্ভব হয়। ৯০ শতাংশ বিভিন্ন কৌশলে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থারও একই মত।

গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ১৪ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড মিলে উদ্ধার করেছে তিন কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৬১০ পিস ইয়াবা। এই সময়ে দেশে ঢুকেছে অন্তত ২৭ কোটি ইয়াবা। জানা গেছে, মিয়ানমারে প্রতি পিস ইয়াবার দাম পড়ে গড়ে ৩০ টাকা। এই হিসাবে উদ্ধার হওয়া ও উদ্ধারের বাইরে থাকা—সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ইয়াবার মূল্য বাবদ ৯০০ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে দেশটিতে।

গত রবিবার রাতে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মাঝিরঘাটে ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে ১৩ লাখ পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেন র‌্যাব-১৫ সদস্যরা। তবে এই বিপুল পরিমাণ ইয়াবা মূল্য পরিশোধ করে আনা হয়েছে নাকি বাকিতে আনা হয়েছে, তা তাত্ক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি র‌্যাব কর্মকর্তারা। র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাত্ক্ষণিকভাবে আমরা জানতে পারিনি এর মূল্য পরিশোধের বিষয়। মামলাটি আমরা তদন্ত করব। ইয়াবার সব বিষয় জানার চেষ্টা করা হবে।’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা ইয়াবা রোধের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

ইয়াবা কেনার টাকা পরিশোধের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের ইয়াবার বড় কারবারিরা এসব ইয়াবার মূল্য পরিশোধের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে দুবাই ও মালয়েশিয়া। সেখানে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে বড় ডিলাররা ইয়াবার মূল্য শোধ করে। এ ছাড়া ওষুধ, স্বর্ণালংকার, বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়েও নিয়ে আসা হচ্ছে এই মাদক। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা কিছু বাংলাদেশিও একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইয়াবার টাকা বিনিময় করে থাকেন। কক্সবাজারের বাসিন্দা টিটি জাফর বর্তমানে দুবাই অবস্থান করছেন। তিনি এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা দেশে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার ডিলার, লাখ লাখ ক্রেতা থাকলেও সেই চেইন ভাঙতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও এর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে সম্ভব হচ্ছে না ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনীতিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যরা জড়িত। সবাই ভাগ পাচ্ছেন। ডিলার-সেলাররাও নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশালী। আর এসব কারণেই চেইন ভাঙা যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সততার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করলে চেইন ভাঙা সম্ভব।’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মাদক নিয়ে আমরা একটি গবেষণা করছি। তাতে দেখা গেছে, ইয়াবাসহ যেসব মাদক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরতে পারে তা মোট মাদকের ১০ শতাংশ। ৯০ শতাংম ধরতে পারে না।’

পরিসংখ্যানে ভয়ংকর চিত্র : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া উদ্ধারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ২৮৭টি ইয়াবা উদ্ধার করেছিল সব সংস্থা মিলে। ১০ বছর পর ২০১৯ সালে তারা উদ্ধার করেছে তিন কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮টি। এর অর্থ, দেশে ইয়াবার জোগান বেড়ে চলেছে।

চলতি বছর গত সাত মাসে শুধু র‌্যাবই উদ্ধার করেছে ৫২ লাখের বেশি ইয়াবা। ২০১০ সালে উদ্ধার হয় প্রায় আট লাখ ১৩ হাজার পিস ইয়াবা, ২০১১ সালে ১০ লাখ ৭৭ হাজার, ২০১২ সালে ২১ লাখ ৩৪ হাজার, ২০১৩ সালে ২৮ লাখ ২২ হাজার, ২০১৪ সালে ৬৫ লাখ ১৩ হাজার, ২০১৫ সালে দুই কোটি এক লাখ আট হাজার পিস, ২০১৬ সালে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৭ সালে চার কোটি ৮০ হাজার, ২০১৮ সালে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার, ২০১৯ সালে তিন কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে সব সংস্থা মিলে। সাড়ে ১১ বছরে ১৯ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৫৬ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। প্রতিটি ইয়াবা মিয়ানমার থেকে কিনে আনা হয় গড়ে ৩০ টাকায়। এই হিসাবে সাড়ে ১১ বছরে উদ্ধার করা ইয়াবার মূল্যই ৫৭৪ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বেশি, যা মিয়ানমারের উৎপাদকদের কাছে চলে গেছে।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) ডিআইজি ড. এ এফ এম মাসুম রব্বানী বলেন, ‘ইয়াবার অর্থ কিভাবে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এই বিষয়টি চিহ্নিত করতে পারলে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখা যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলাও দেওয়া হচ্ছে।’

প্রায় দিনই সীমান্ত এলাকা থেকে বিজিবি উদ্ধার করছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা। জানতে চাইলে কক্সবাজারের বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, ‘ইয়াবা রোধে চাহিদা কমাতে হবে। চাহিদা কমানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। দেশে যাতে ইয়াবা ঢুকতে না পারে, সে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।’

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, একসময় মিয়ানমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াবা উৎপাদন করা হতো। কিন্তু এই ইয়াবার টাকা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে চলে যাওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারও বর্তমানে ইয়াবার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। দুই দেশ মিলে চেষ্টা করলে ইয়াবা রোধ করা সম্ভব হবে বলে মত দেন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। কালেরকন্ঠ ।

আরও খবর