রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর: সমাবেশের অনুমতি নেই, স্বেচ্ছায় ঘরে থাকবেন রোহিঙ্গারা

রফিক উদ্দিন বাবুল ◑

মিয়ানমারের রাখাইনের একটি মসজিদে ইমামতি করতেন মাওলানা ফজলুল করিম (৪৫)। প্রতিদিনের ন্যায় সে সকালে মসজিদের বারান্দায় ছেলে-মেয়েদের কোরআন শিক্ষা দিচ্ছিলেন। ঠিক এ সময়ে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও সশস্ত্র রাখাইন সন্ত্রাসীদের গুলি বর্ষণে দিক বেদিক ছুটাছুটি করে পালানোর সময় সেও পাশর্^বর্তী এক ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়ে। ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে এসে দেখে তার মাদ্রাসায় আগুন জ¦লছে। ৭/৮ জন ছেলে-মেয়ে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মাটিতে লুটে পড়ছে। বিভিষিকাময় এ ভয়ানক দৃশ্য দেখে সে আর এক মুহুর্তও দেরি করেনি। ৫ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট সে আনজুমান পাড়া সীমান্ত দিয়ে কুতুপালং এসে আশ্রয় নেয়। কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে বসবাসরত মাওলানা ফজলুল করিম জানান, এসময় তার মতো হাজার হাজার মানুষ মিয়ানমারে পথে প্রান্তরে অবস্থান নিয়ে এদেশে চলে আসার জন্য অপেক্ষমান ছিল। কিন্তু মাওলানা করিমদের শরণার্থীর জীবনের অবসান হয়নি ৩ বছরেও।

থাইংখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের একটি ঝুপড়িতে বসবাস করছে মাইমুনা খাতুন (২৮)। তার কোলে একটি শিশু বয়স ৩ বছর। আর একটি মেয়ে পাশে বসে ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নাম জানতে চাইলে বলেন, আছিয়া (৭)। স্বামীর কথার জানতে চাইলে মাইমুনা চোখের অশ্রু ফেলে জানায়, তারা প্রতিদিনের ন্যায় খেয়ে ধেয়ে ঘুমাচ্ছিল। এসময় মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিলে শিশু দু’ইিকে বাইরে এসে দেখি সেনারা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সকালে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি তার স্বামী শামশুল আলমকে সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। উপায়ন্তর না দেখে পাড়ালিয়াদের সাথে আজকের এই দিনে থাইংখালী রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে তাজনিমারখোলা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়। প্রায় তিন দিন তিন রাত অবিশ্রান্ত হেটে আমার শরীর অবস হয়ে যাচ্ছিল। শিশু ২টির অবস্থাও কাহিল। এসময় কে বা কারা এসে খাবার দিলে আমরা কোন রকম বেঁেচ আছি। সে তার অনুভুতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারানো স্বামীর জন্য বার বার কাদঁ ছিল।

৩ বছর শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাকিমপাড়া ক্যাম্পের মাঝি নবী হোছন জানান, যদিওবা বাংলাদেশ সরকার তাদের সাহায্য সহযোগীতা, থাকা খাওয়া, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছে তাতে তারা খুশি। তবে তারা সুখি নয়। জানতে চাইলে বলেন, মাতৃভূমির জন্য বার বার মন কাদঁছিল। সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য বেশ তৎপর হলেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় চিন্তিত আছি। তবে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবো এ চিন্তায় দিন গুনছি।

ইউএনএইচসিআর এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশকারী আরো চার লাখ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কূটনীতিক তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক বিশে^র চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও বিভিন্ন তালবাহনা শুরু করে কালক্ষেপন করলে প্রত্যাবাসান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় উখিয়া টেকনাফে বিভিন্ন লোকলয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় মানুষের মনোভাব ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে রোহিঙ্গা মাঝিদের অভিমত।

বিশে^র সবচেয়ে বৃহত্তম শরণার্থী উখিয়ার কুতুপালংয়ে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। এখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠেছে শত শত দোকানপাট ও হাটাবাজার। সকাল সন্ধ্যা এসব হাটবাজারে জমজমাট বেচা কেনা হচ্ছে। এমনকি রাখাইনের কয়েকটি নাম করা বাজার যেমন বলি বাজার ও শাহাব বাজারের আদলে গড়ে উঠা বাজার গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে রোহিঙ্গারা।

এখানে স্বর্ণের দোকান থেকে শুরু করে কসমেটিকস, কাপড়, ওষুধ সামগ্রীসহ যাবতীয় নিত্যপণ্য হাতবাড়ালে পাওয়া যাচ্ছে। ক্যাম্প ঘিরে নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছেন রোহিঙ্গারা। ৩৪টি ক্যাম্পের প্রতিটিতে তাদের নিজস্ব নেতৃত্বের কাঠামো রয়েছে। ক্যাম্প ইনচার্জের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ক্যাম্পে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতি ব্লকে রয়েছেন একজন করে নেতা, যাকে মাঝি বলে ডাকেন রোহিঙ্গারা।

সোমবার বিকালে ওই আশ্রয় শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের আড্ডা-গল্প আর বিকিকিনিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। একটি দোকানে রোহিঙ্গা ভাষায় গানও পরিবেশন করছিলেন বেশ কিছু রোহিঙ্গা। কুতুপালং ও লম্বাশিয়া দুই ক্যাম্পের দুই জায়গায় বল নিয়ে খেলতে দেখা যায় রোহিঙ্গা তরুণদের।
থাইংখালী হাকিমপাড়া ক্যাম্পের মোহাম্মদ গফুর বলেন, মিয়ানমারের মংডুতে একটি মসজিদে তাবলীগ জামাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গোলাগুলির মুখে পড়েছিলেন। সেদিন চোখের সামনে আটজনকে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছেন তিনি। গুলি লেগেছিল তার গায়েও, তবে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে আসতে পেরেছিলেন। মসজিদ থেকে সেদিন বাড়ি ফিরে গফুর দেখেন, স্ত্রী, সাত ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। বাড়ী থেকে তখনোও ঘরপুড়া ধোঁয়া উড়ছিল। এরপর সে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে এদেশে চলে আসে। থাইংখালী এসে হাকিমপাড়া ক্যাম্পের তার পরিবারের সদস্যদের খোঁজ পেয়ে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই ভুলে গেলেন অনেক কষ্টে আসা দিনগুলোর কথা।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩২ জন শিশু বসবাস করছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের জন্ম হয়েছে ক্যাম্পেই। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, এদের মধ্যে ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু প্রায় তিন লাখ। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩ লাখ ৯০ হাজার শিশু বিভিন্ন তিষ্ঠান থেকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার শিশুর কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ হয়নি। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের ৯৭ শতাংশই শিক্ষার বাইরে থাকছে জানিয়ে ইউনিসেফ বলছে, অপরাধ, শিশুশ্রম, মানব পাচার ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে এরা।

কুতুপালং রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ বলেন, আজ ২৫ আগষ্ট যাতে ক্যাম্পে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোহিঙ্গারা করতে না পারে সে ব্যাপারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে এ দিন ক্যাম্প থেকে কোন রোহিঙ্গা বাইরে যেতে পারবে না, ৪/৫ জন রোহিঙ্গা জমায়েত হতে পারবে না। এছাড়া সভা সমাবেশ, মিছিল মিটিং, প্লে কার্ড, ব্যানার পেষ্টুন বহন করা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ৪৯ সদস্য বিশিষ্ট ৭টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্যরা ক্যাম্প পুলিশের সাথে ক্যাম্পে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালণ করার কথা রয়েছে।

তিনি বলেন, তাই বিগত দিনের ন্যায় ক্যাম্পে কোনরূপ কর্মসূচী থাকছে না বলে ওই চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ খলিলুর রহমান জানান, ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই রোহিঙ্গারা যাতে এ দিনে ক্যাম্পে কোনরূপ কর্মসূচী দিতে না পারে সে জন্য ক্যাম্প প্রশাসনকে তৎপর রাখা হয়েছে। দিক নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে ক্যাম্প মাঝিদের। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর